ভুল স্বীকার করা ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী নয়
ধর্ম ও জীবন।।
চলার পথে আমাদের অনেকের ভুল হয়ে যায়। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় আমরা প্রায়ই ভুল করে ফেলি। কেউ কেউ যখন ভুল বুঝতে পারে তা শুধরে নেয়। আবার কেউ নিজের ভুলের ওপর গোঁ ধরে বসে থাকে।
এই মনে করে যে ভুল স্বীকার করা ব্যক্তিত্বের পরিপন্থী। হয়তো এর কারণে নিজের সম্মানহানি হবে। অথচ বিষয়টি একেবারেই এমন নয়। মানুষ ভুল করবে—এটাই স্বাভাবিক।
আর মহৎ গুণগুলোর একটি হচ্ছে, কৃত ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া। ভুল করে ক্ষমা প্রার্থনা করবে এটাই মানুষের বৈশিষ্ট্য। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে তাওবাকারীরা উত্তম। ’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৫১)
আবু বকর ও ওমর (রা.)-এর ঘটনা
ভুল হয়ে গেলে ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার চমৎকার উদাহরণ রেখে গেছেন রাসুলের প্রিয় সাহাবি আবু বকর ও ওমর (রা.)। আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)-এর মধ্যে বিতর্ক হলো, আবু বকর (রা.)-এর কোনো কথায় ওমর (রা.) রাগান্বিত হন। এবং রাগান্বিত অবস্থায় ওমর (রা.) সেখান থেকে চলে গেলেন। আবু বকর (রা.) তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে তাঁর পিছু নিলেন, কিন্তু ওমর (রা.) ক্ষমা করলেন না, বরং তাঁর সম্মুখের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এরপর আবু বকর (রা.) রাসুল (সা.)-এর দরবারে এলেন।
আবু দারদা (রা.) বলেন, আমরা তখন রাসুল (সা.)-এর কাছে ছিলাম, ঘটনা শোনার পর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের এই সঙ্গী আবু বকর আগে কল্যাণ লাভ করেছে। ’ তিনি বলেন, এতে ওমর লজ্জিত হলেন এবং সালাম করে নবী (সা.)-এর পাশে বসে পড়েন। সব কথা রাসুল (সা.)-এর কাছে বর্ণনা করেন। আবু দারদা (রা.) বলেন, এতে রাসুল (সা.) অসন্তুষ্ট হলেন। আর আবু বকর (রা.) বারবার বলছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি বেশি দোষী ছিলাম। ’ পুনরায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আমার খাতিরে আমার সাথির ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? তোমরা আমার খাতিরে আমার সঙ্গীর ত্রুটি উপেক্ষা করবে কি? এমন একদিন ছিল যখন আমি বলেছিলাম, হে লোকসকল! আমি তোমাদের সকলের জন্য রাসুল, তখন তোমরা বলেছিলে, তুমি মিথ্যা বলেছ আর আবু বকর (রা.) বলেছিল, আপনি সত্য বলেছেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৬৪০)
‘আমি ভুল করেছি, আমাকে মাফ করে দিন। ’ এটুকু কথায় লুকিয়ে থাকা সব ক্ষোভ রফা করে দিতে পারে মুহূর্তেই। কিন্তু সমাজে ভুল স্বীকার করার মানুষ খুব কম। অথচ এই অনুশোচনায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের প্রকাশ ঘটে।
তাই ভুল হলে আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নিজের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা। এতে দুর্বলতা নয়, উদারতা প্রকাশ পায়। তাই ভুল হলে আমাদের করণীয়—
এক. ভুল স্বীকার করা এবং অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া। আর এর দায়ভার মেনে নেওয়া। কোনো মাধ্যম ব্যতীত যার সঙ্গে ভুল হয়েছে সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে দুঃখ প্রকাশ করা। আর প্রকাশ্যে ভুল করলে প্রকাশ্যে তার জন্য অনুতপ্ত হওয়া। কারো প্রতি দায়ভার না চাপিয়ে নিজেই সব মেনে নেওয়া। নিজের ভুল স্বীকার করতে গিয়ে আকার-ইঙ্গিতে কাউকে দোষারোপ না করা।
দুই. ভুল যদি নিজের অজান্তে হয়ে থাকে তাহলেও তা মানুষের সামনে স্পষ্ট করা। ইনশাআল্লাহ, এর দ্বারা আপনার সম্মান বৃদ্ধি হবে। তবে বারবার যেন একই ভুল করা থেকে পূর্ণ সতর্ক থাকা, নয়তো এর কারণে মানুষের মধ্যে আপনার তথা ওজন কমে যাবে। উল্টো আপনি হবেন হাসির পাত্র।
তিন. কৃত ভুলের কারণে যদি কোনো সংকট তৈরি হয় তা মেনে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা। এ ক্ষেত্রে কোনো তিরস্কারের সম্মুখীন হলে ধৈর্য ধারণ করা। তার সঙ্গে অহেতুক তর্কে না জড়ানো; বরং অনুশোচনা প্রকাশ করা।
ভুল স্বীকার করা নবীদের বৈশিষ্ট্য ছিল। অথচ তাঁরা ছিলেন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁরা আমাদের জন্য নমুনা হিসেবে রেখে গেছেন ভুল স্বীকার মানুষের মর্যাদাকে ছোট করে না।
আদম (আ.)-এর ভুল স্বীকার
আমাদের পিতা আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) যখন বুঝতে পেরেছেন শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তাঁরা ভুল করেছেন এবং নিষিদ্ধ গাছ থেকে ফল ভক্ষণ করেছেন। তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। আল্লাহ বলেন, তারা বলল, ‘হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করছি। আর যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন এবং দয়া না করেন, তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবো। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২৩)
মুসা (আ.)-এর ভুল বুঝতে পারা
নবুয়ত প্রাপ্তির আগের মুসা (আ.) যখন জনৈক কিবতিকে চড় দিতে গিয়ে হত্যা করেছিলেন। তখন তিনি সঙ্গে সঙ্গে এ কথা স্বীকার করলেন—এই কাজটি শয়তানের প্ররোচনায় হয়েছে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে থাকলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর তিনি নগরীতে প্রবেশ করলেন, যখন এর অধিবাসীরা ছিল অসতর্ক। সেখানে তিনি দুটি লোককে সংঘর্ষে লিপ্ত দেখলেন, একজন তার নিজ দলের এবং অন্যজন তার শত্রুদলের। অতঃপর মুসার দলের লোকটি ওর শত্রুর বিরুদ্ধে তার সাহায্য প্রার্থনা করল, তখন মুসা তাকে ঘুষি মারলেন এভাবে তিনি তাকে হত্যা করে বসলেন। ’ মুসা বললেন, ‘এটা শয়তানের কাণ্ড। সে তো প্রকাশ্য শত্রু ও বিভ্রান্তকারী। তিনি বলেন, ‘হে আমার রব! আমি তো আমার নিজের প্রতি জুলুম করেছি; কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর তিনি তাকে ক্ষমা করেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। ’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ১৫, ১৬)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে বোঝার তাওফিক দান করুন।