নাটক শেষে পেনাল্টিতে হার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের
✒️স্পোর্টস ডেস্ক
ঘটনার আকস্মিকতা বুঝতে না পেরে এমবাপ্পে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রেফারির কাছে অনুযোগের ভঙ্গি করলেন। ওদিকে ইয়ান সমারও কী করবেন বুঝতে না পেরে একবার গোল লাইন রেফারি ও একবার মূল রেফারির দিকে তাকালেন। যখন বুঝলেন পঞ্চম পেনাল্টির কোটা আসলেই শেষ শুরু হলো পাগলাটে দঊড়। একটু পরই সতীর্থদের ভীরে হারিয়ে গেলেন সুইস গোলকিপার সমার। ওদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে হাঁটা শুরু করলেন এমবাপ্পে।দিনের প্রথম ম্যাচেই সব নাটকীয়তা শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। ৩-১ থেকে ৩-৩ হয়ে যাওয়া ম্যাচে ৫-৩ ব্যবধানে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্পেনের জয়ের সে ম্যাচকে ইউরোর সেরা ম্যাচ বলা যায়। কিন্তু ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচ তাহলে পিছিয়ে থাকবে কেন?
বুখারেস্টে শেষ ষোলোর এই ম্যাচে নাটকীয়তার উপাদান যে ছিল আরও বেশি। ফ্রেঞ্চ কোচের ভুল সিদ্ধান্ত, সুইসদের এগিয়ে যাওয়া, ভিএআর থেকে পেনাল্টি পাওয়া, সে পেনাল্টি আবার হাতছাড়া করা। এর মধ্যেই ১০২ সেকেন্ডের মধ্যে করিম বেনজেমার দুই গোল, পগবার স্ক্রিমারে ফ্রান্সের ৩-১ গোলে এগিয়ে যাওয়া, সুইসদের আবার ম্যাচে ফেরা, সমতায় ফেরানো গোল অফসাইডে বাতিল হওয়া, নির্ধারিত সম য়ের শেষ মিনিটে আবার সমতায় ফেরা-মশলার অভাব ছিল না কোনো।
উত্থান-পতনের ম্যাচে শেষ হাসি সুইজারল্যান্ডের। পেনাল্টি শ্যুটআউটে ৫-৪ ব্যবধানে জিতে কোয়ার্টার ফাইনালে চলে গেল সুইসরা। সেখানে স্পেনের মুখোমুখি হবে তারা। পেনাল্টিতে ফ্রান্সের পঞ্চম শট থেকে গোল করতে পারেননি কিলিয়ান এমবাপ্পে।
ম্যাচ শুরু হওয়ার এক ঘন্টা আগ থেকেই আলোচনা শুরু। দিদিয়ের দেশম এত বড় একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলেন? ক্লেম লংলের ডিফেন্ডিং নিয়ে বার্সেলোনা সমর্থকদের হতাশা মৌসুমজুড়েই টের পাওয়া গেছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বড় বড় ভুল করায় এই ডিফেন্ডারের খ্যাতি বেশ। সেই লংলেকে মাঝে রেখে তিন সেন্টারব্যাকের ডিফেন্স!
দেশমকে ভুল এবং সমর্থকদের শঙ্কাকে সঠিক প্রমাণ করতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগল লংলের। বাঁ প্রান্ত দিয়ে ক্রস করেছিলেন স্টিভেন জুবের। সে ক্রস দেখে লাফিয়ে উঠলেন হারিস সেফেরোভিচ। রক্ষণের কেন্দ্রে থাকা লংলের দায়িত্ব ছিল সেফেরোভিচকে আটকে রাখার। কিন্তু সেফেরোভিচের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারলে তো! লংলে এমনকি লাফও দেননি হেড দেওয়ার জন্য!
এই গোল দিয়ে অনন্য এক রেকর্ড গড়লেন স্টিভেন জুবের। ইউরোপের সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়ের তালিকা করলে সেরা পঞ্চাশেও জায়গা মিলবে না এই সুইস মিডফিল্ডারের। কিন্তু এই ইউড়তে এ পর্যন্ত চারটি গোল বানিয়ে দিয়েছেন জুবের। ১৯৮০ সালের পর থেকে ইউরোর এসিস্টের খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে। সে অনুযায়ী এক টুর্নামেন্টে এর আগে কোনো খেলোয়াড় সতীর্থদের দিয়ে চারটি গোল করাতে পারেননি।
গোল খাওয়ার পরই জেগে উঠেছে ফ্রান্স-এমন কিছু লেখা যাচ্ছে না। প্রথমার্ধের বাকি সময়েও সুইজারল্যান্ডই এগিয়ে ছিল আক্রমণ গড়ায় কিংবা বিপদ সৃষ্টিতে সুইসদের চেয়ে বেশ পিছিয়ে ছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। কিলিয়ান এমপবাপ্পে, আঁতোয়ান গ্রিজমান কিংবা পল পগবাদের নাম তবু সুযোগ নষ্ট করার সুবাদে নেওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পর্তুগালের বিপক্ষেই জোড়া গোল করে ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দেওয়া করিম বেনজেমাকে প্রথমার্ধে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু নাটকের যে বাকি তখনো অনেক।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই লংলেকে তুলে কিংসলে কোমানকে নামানো হয়। ৩ ঝনের ডিফেন্সের পরীক্ষা নিরীক্ষা ভুলে চার রক্ষণে ফেরে ফ্রান্স। তবে গোলের সুযোগ সুইজারল্যান্ডই আগে পেয়েছে। ৫০ মিনিটে ব্যবধান বাড়ানোর সম্ভাব্য সেরা সুযোগ নষ্ট করেছেন জেরদান শাকিরি। দুই মিনিট পরই আরেকটি সম্ভাবনা নষ্ট করেছে দলটি।
কিন্তু একটু পরই সে দুঃখ প্রায় উবে গিয়েছিল তাদের। কারণ ফ্রান্সের প্রতি আক্রমণ শেষ হতেই রেফারি বাঁশি বাজালেন। কারণ, ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি সম্ভাব্য পেনাল্টি চেক করতে বলেছেন রেফারিকে। ভিডিওতে দেখা যায়, জুবেরকে ঠেকানোর সময় বেঞ্জামিন পাভার ফাউল করেছিলেন। পেনাল্টি!চার মিনিটের মধ্যে তৃতীয়বারের মতো এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ নষ্ট করল সুইজারল্যান্ড। সুইস পেনাল্টি স্পেশালিস্ট রিকার্ডো রদ্রিগেজ যে পেনাল্টি নিলেন সেটা ঠেকাতে কোনো কস্ট হলো না উগো লরিসের।
৫৫ মিনিটে পেনাল্টি মিস করলেন রদ্রিগেজ। ফ্রান্স সেটার দাম বুঝিয়ে দিল পরের চার মিনিটে। ৫৬ মিনিটে পগবার দারুণ এক পাস পেয়েও একটুর জন্য গোল পাননি এমবাপ্পে। পরের মিনিটে সে দুঃখ ভুললেন গোলে সহায়তা করে। যদিও গোলের কৃতিত্ব পুরোপুরি বেনজেমার। গ্রিজমান হয়ে এমবাপ্পের কাছ থেকে পাওয়া বল অবিশ্বাস্যভাবে পেছনের পা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে বক্সের আরও ভেতরে চলে গেলেন। এভাবে বল নিয়ে ঢুকতে পারাও যে সম্ভব সেটা বুঝতে না বুঝতেই গোল।এবারের ইউরোতে আক্রমণের সেরা ত্রয়ী বলা হচ্ছিল এমবাপ্পে-বেনজেমা-গ্রিজমানকে। প্রথম গোলের মতো পরের গোলেও তিনটি নামই নিতে হলো। মাঝমাঠে পগবা-কোমানের সুবাদে বাঁ প্রান্তে একটু জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন এমবাপ্পে ও গ্রিজমান। এবার গ্রিজমানের দিকে নজর দিতে গিয়ে বেনজেমার দিকে নজর দেয়নি সুইস ডিফেন্স। গ্রিজমানের ক্রস থেকে পস্টের এক গজ সামনে থেকে হেডে বেনজেমার দ্বিতীয় গোল।
১০২ সেকেন্ডের মধ্যে দুই গোল! বিশ্বমানের একটা দলকে বাগে পেয়েও সুযোগ কাজে লাগাতে না পারার অপরাধের শাস্তি ১০২ সেকেন্ডেই পেয়ে গেল সুইজারল্যান্ড।
ম্যাচটা ৭৫ মিনিটে শেষ করে দিয়েছিলেন পগবা। অন্তত এমনটাই বলে হয়েছিল।
বক্সের ভেতর থেকে দূরের কোণ লক্ষ্য করে শট নিয়েছিলেন বেনজেমা। কিন্তু সে বল প্রতিপক্ষের গায়ে লেগে ফেরে। বক্সের বাইরে থেকে একই কোণ লক্ষ্য করে নেওয়া পগবার শট কারও পক্ষে আটকানো সম্ভব ছিল। একেবারে নিখুঁত এক শট পোস্ট ও ক্রসবারের কোণ দিয়েই ঢুকেছে জালে।
কিন্তু নাটক তখনো শেষ হয়নি। ৮১ মিনিটে সেফেরোভিচের আরেকটি হেড লরিসকে ফাঁকি দিল। বদলি নামা এমবাবুর ক্রস থেকে সেফেরোভিচের সে গোলের চমক কাটাতে না কাটাতেই আরেকটি গোল করে বসেছিল সুইজারল্যান্ড! কিন্তু ৮৫ মিনিটে মারিও গাভরানোভিসের সে গোল সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল হয় অফসাইডে।
ফ্রান্স সময় নষ্ট করার খেলায় নামে। গ্রিজমানকে তুলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মুসা সিসোকোকে নামানো হয় ম্যাচটা শেষ করে আসার জন্য। সে উদ্দেশ্য প্রায় সফল হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে আবার নাটক। ৯০ মিনিটে মাঝমাঠে বল হারান পগবা। সেখান থেকে গ্রানিত শাকা খুঁজে নিলেন বক্সের কাছে থাকা গাভরানোভিচ। কিমপেম্বেকে বোকা বানিয়ে যে শট নিলেন দিনামো জাগরেব স্ট্রাইকার তা ঠেকানোর কোনো সুযোগ পাননি লরিস। ৩-৩!
যোগ করা সময়ের চতুর্থ মিনিটে কোমানের শট পোস্টে লেগে ফেরায় ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।শুরুতেই ধাক্কা খায় ফ্রান্স। এমনিতেই গ্রিজমানকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। হালকা চোট পাওয়া বেনজেমাও মাঠ ছাড়লেন। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধে প্রাধান্য ছিল সুইজারল্যান্ডেরই। দ্বিতীয়ার্ধে কিংসলে কোমানকেও হারিয়েছে ফ্রান্স। এমবাপ্পের সঙ্গে আক্রমণের দায়িত্বটা পান অলিভিয়ের জিরু ও মার্কাস থুরাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। অতিরিক্ত সময়ে গোল পায়নি কোনো দল। পেনাল্টি শ্যুট আউটই মহা নাটকীয় এ ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণের উপায় হয়ে ওঠে।শ্যুটআউটে একে একে শট নিতে এসেছেন গাভরানোভিচ, পগবা, শার, জিরু, আকাঞ্জি, থুরাম, ভার্গাস, কিম্পেম্বে, মেহমেদি ও এমবাপ্পে। এর মধ্যে ভার্গাসের শট হাতে লাগালেও জালে যাওয়া ঠেকাতে পারেননি লরিস। ওদিকে পুরো ম্যাচে হতাশ করা এমবাপ্পে পেনাল্টিতেও দলকে ডুবিয়েছেন। তাঁর নিচু দুর্বল শট আটকে দেন সমার।