২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৩ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুমিল্লায় ৪ কোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্ট পণ্যসহ গ্রেফতার ৪

নিজস্ব প্রতিনিধি।।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বেলতলী এলাকা থেকে প্রায় ৪ কোটি টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য চোরাই গার্মেন্ট পণ্য ও একটি কাভার্ডভ্যানসহ আন্তঃজেলা চোরচক্রের চার সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৪।

বুধবার (৮ আগস্ট) রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- মো. হিমেল ওরফে দুলাল (৩৮), আবুল কালাম (৪০), মো. মহসিন আলী ওরফে বাবু (৩১) ও মো. আল আমিন (৩০)। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদিকে অভিযানের সময় এ ঘটনায় জড়িত আরও তিন-চারজন ব্যক্তি পালিয়ে গেছেন।

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।

তিনি বলেন, গত ১৪ আগস্ট ঢাকা জেলার আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের নেওয়ার পথে কয়েকটি কাভার্ডভ্যান থেকে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ দামি গার্মেন্ট পণ্য উধাও হয়ে যায়। এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে র‌্যাব।

তদন্তের একপর্যায়ে ফ্যাক্টরি থেকে পণ্য নিয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার একটি পরিত্যক্ত রি-রোলিং কারখানায় কাভার্ডভ্যান থামিয়ে চুরির সময় আন্তঃজেলা চোরচক্রের মূলহোতা মো. সিরাজুলসহ ছয়জনকে আটক করা হয়।

এ সময় ছয় কোটি টাকা মূল্যের ৪১ বস্তা ও ৫০৬ কার্টন গার্মেন্ট পণ্য উদ্ধার করা হয়। পরবর্তীকালে জামিনে বের হয়ে সিরাজুল একই কাজ শুরু করেছেন বলে তথ্য পায় র‌্যাব-৪।

র‌্যাব বলছে, গ্রেফতার আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মিরপুর, উত্তরা, আশুলিয়া ও গাজীপুর থেকে রপ্তানিযোগ্য গার্মেন্ট পণ্য চুরি করে স্থানীয় বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করে আসছেন। এ কাজে তারা পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত চালকদের সহযোগিতা নিতেন।

সংবাদ সম্মেলন থেকে আরও জানা যায়, গ্রেফতার হিমেল ভোলা জেলার সদর উপজেলার পূর্ব ইলিশা গ্রাম থেকে ২০১০ সালে ঢাকায় আসেন।

শুরুতে তিনি বিল্ডিং কনস্ট্রাকশনের রডমিস্ত্রির কাজ করতেন। পরবর্তীকালে পেশা পরিবর্তন করে কিছুদিন লেগুনার হেলপার ও পরে ড্রাইভিং শিখে প্রাইভেটকার ও বাসের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করেন।

২০২০ সালের শুরুতে এ চোরচক্রের মূলহোতা সিরাজুলের সঙ্গে পরিচয় হয় হিমেলের। একপর্যায়ে হিমেল পলাতক সিরাজুলের সঙ্গে পরিকল্পনা করে চোরচক্রের অন্যতম সদস্য হয়ে কাজ করে আসছিলেন।

গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যায়, এ কাজের মাধ্যমে হিমেল অল্প দিনে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে যান। এ অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে তিনি একটি কাভার্ডভ্যান কেনেন। এছাড়া ঢাকা ও ভোলায় তার একাধিক বাড়িসহ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।

পলাতক আসামি সিরাজের ঢাকায় একাধিক বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। গ্রেফতার আবু কালাম পেশায় দক্ষ মিস্ত্রি। তিনি মূলত কাভার্ডভ্যানের নাট-বল্টু খুলতে পারদর্শী। তিনি প্রতিবার চুরির সময় লক্ষাধিক টাকা পেতেন।

গ্রেফতার মহসীন আলী ওরফে বাবু কুমিল্লায় একটি গুদামের মালিক। ওই গুদামেই চুরি করা পণ্য লোড-আনলোড করে রাখা হতো। মূলত তার ছত্রচ্ছায়ায় কুমিল্লায় কাভার্ডভ্যান লোড-আনলোড ও পণ্য রেখে দেওয়া হতো। অপর আসামি আল আমিন একজন গার্মেন্টস পণ্য লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক।

চক্রের চুরির কৌশল:

চক্রটি প্রথমে কাভার্ডভ্যানের চালকের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে। এরপর বিভিন্ন লোভ দেখানোর পাশাপাশি চুরি করা পণ্য বিক্রির টাকার অংশ দেওয়ার কথা বলে রাজি করানো হয়। নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নিকটবর্তী নির্জন এলাকায় কাভার্ডভ্যান পার্কিং করা হতো।

পরবর্তীকালে চোরচক্রের মূলহোতা মো. সিরাজুলের দেওয়া তথ্য অনুসারে গ্রেফতার হিমেল, আবুল কালাম, মহসিন, আলামিন ও পলাতক সহযোগী নুর জামানসহ আরও কয়েকজন মিলে বিশেষ কৌশলে কাভার্ডভ্যানের পাশের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে প্রত্যেক কার্টনের ৩০-৪০ শতাংশ মালামাল সরিয়ে নিতেন। কার্ভাডভ্যানের সিলগালা করা তালা তারা খুলতেন না।

চোরচক্রটি কার্টনের ওজন ঠিক রাখাতে যে পরিমাণের পণ্য সরিয়ে নেওয়া হতো, সে পরিমাণ ঝুট কার্টনের ভেতরে রেখে প্যাকিং করতেন। ফলে বন্দরে স্ক্যানিং কিংবা ওয়েট মেশিনে কোনো ধরনের অনিয়ম ধরা পড়তো না।

তিনটি প্রক্রিয়ায় গার্মেন্ট পণ্য চুরি করা হতো। প্রথমত, ফ্যাক্টরি থেকে পণ্য সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে না নিয়ে পথিমধ্যে সুবিধাজনক সময়ে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কুমিল্লা কিংবা আশপাশের নির্জন এলাকা-পরিত্যক্ত ভবনের ভেতর কাভার্ডভ্যান পার্কিং করে।

দ্বিতীয়ত, নাট-বল্টু খোলায় পারদর্শী সদস্যরা বিশেষ কৌশলে কাভার্ডভ্যানের সিলগালা তালা না খুলে সরাসরি কাভার্ড ভ্যানের সাইডের ওয়ালের নাট-বল্টু খুলে ফেলতেন। অন্য সহযোগীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিটি কার্টনে সমপরিমাণ ঝুট রেখে আবার প্যাকেট করতেন।

তৃতীয়ত, স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় ও গার্মেন্ট পণ্যের গুণগত মান উন্নত হওয়ায় আসামি সিরাজুল, তার সহযোগী নুর জামান ও গ্রেফতার হওয়া হিমেল দ্রুত সময়ে সব পণ্য বিক্রি করে প্রত্যেককে ভাগ বুঝিয়ে দিতেন।

গার্মেন্টস মালামাল চুরি যাওয়ায় দেশের ক্ষতি:

পণ্য চুরি যাওয়ার ফলে পুনরায় চুরি যাওয়ার সমপরিমাণ পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠাতে হয়। এতে ফ্যাক্টরি মালিকদের সময় ও অর্থের প্রচুর ক্ষতি হয়।

বিদেশি ক্রেতারা সঠিকভাবে ও সঠিক সময়ে পণ্য না পাওয়ায় মূল্য পরিশোধ করতেন না। পরবর্তীকালে ক্রেতারা আর ক্রয়াদেশ দিতেন না। ফলে দিন দিন দেশের গার্মেন্ট সেক্টর প্রচুর লোকসানের সম্মুখীন হচ্ছিল।

র‌্যাবের দাবি, এভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রতি বছর শত কোটি টাকার বেশি পোশাক এসব চক্রের মাধ্যমে চুরি হচ্ছে।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!