৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুবর্ণ সময় ইতিকাফ

ধর্ম ও জীবন ডেস্ক।।
গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির।।
আল্লাহর অনুগ্রহ লাভ ও পাপ মোচনের অবারিত সময় মাহে রমজান। এ মাসের শেষ ১০ দিন সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময়।

এ সময় ইতিকাফের মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্যে এসে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফ থাকাবস্থায় তাদের (স্ত্রী) সঙ্গে মিলন করবে না, তা আল্লাহর সীমারেখা, তোমরা এর নিকটেও আসবে না, এভাবে আল্লাহ তায়ালা মানুষের কাছে তাঁর নিদের্শনাবলী তুলে ধরেন, যেন তাঁরা মুত্তাকি হয়।
’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৭)

ইতিকাফের পরিচয় : ইতিকাফ আরবি শব্দ। এটি আরবি শব্দ ‘আকফ’ ধাতু থেকে উদগত।

অর্থ- অবস্থান করা। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জাগতিক কাজকর্ম ও পরিবার পরিজন থেকে বিছিন্ন হয়ে বিশেষ সময়ে ও বিশেষ নিয়মে আল্লাহর ইবাদতের নিয়তে নিজেকে আবদ্ধ রাখাকে ইতিকাফ বলে।

ইতিকাফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য :

ইতিকাফের অনেক গুরুত্ব ও মর্যাদা আছে। বরকতপূর্ণ রাত লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি, গুনাহ মুক্ত জীবন গঠন, একাকী সংগোপনে মহান রবের ইবাদত, আত্মিক উন্নতি সাধন করা যায়। তাছাড়া বছরের বাকি সময় ইবাদতের অনুশীলনসহ অসংখ্য সমৃদ্ধ জীবন গঠনে সহায়ক হলো ইতেকাফ। ইবনে উমার (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রমজানের শেষ দশকে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং : ১১৭১)

আবু হুরাইরা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘প্রতি রমজানের ১০ দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন। ’ (বুখারি, হাদিস নং : ১৯০৩)

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন রমজানের শেষ দশক আগমন করত রাসুল (সা.) তাঁর কোমর বেঁধে ইবাদত করতেন, রাত জাগতেন আর তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও জাগাতেন। ’ (ইবনে খুজাইমা)

ইতিকাফের প্রকারভেদ : ইতিকাফ তিন প্রকার।

এক. সুন্নাত ইতিকাফ: রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্ব মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।

দুই. ওয়াজিব ইতিকাফ : নজর বা মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধান হলে আমি এতদিন ইতিকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি একদিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যতদিন শর্ত করা হবে ততদিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত।

তিন. নফল ইতিকাফ: সাধারণভাবে যেকোনো সময় ইতিকাফ করাকে নফল ইতিকাফ বলে। এর জন্য কোনো দিন কিংবা সময়ের নির্ধারিত নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। এ জন্য মসজিদে প্রবেশের পূর্বে ইতিকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা উত্তম।

ইতিকাফের স্থান : ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান হলো পবিত্র মসজিদুল হারাম। এরপর মসজিদে নববি। এরপর যথাক্রমে বাইতুল মাকদিস, জুমা আদায়ের মসজিদ ও মহল্লার মসজিদে।

নারীদের ইতিকাফ : পুরুষদের মতো করে নারীদের ইতিকাফ করাও সুন্নত। তবে নারীদের মসজিদের বদলে ঘরে ইতিকাফ করা উত্তম। ঘরের নির্দিষ্ট নামাজের স্থানে তারা ইতিকাফ করতে পারে। আর কারো যদি নামাজের জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকে তাহলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে তাতে ইতিকাফের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ বিষয়ে আয়েশা (রা.) থেকে একটি হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন । এরপর তাঁর স্ত্রীগন ইতিকাফ করেছেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং : ১৮৬৮, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং : ২০০৬)

ইতিকাফ অবস্থায় যা করণীয় : ১. বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করা, ২. কোরআন তিলাওয়াত করা, ৩. দ্বীনি আলোচনা করা ও শোনা, ৪. আল্লাহর জিকির করা, ৫. দোয়া করা, ৬. ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করা।

ইতিকাফ অবস্থায় যা বর্জনীয় : ১. একেবারেই চুপচাপ বসে থাকা, ২. ঝগড়া-ঝাটি বা অনর্থক কথাবার্তা না বলা, ৩. গীবত বা পরনিন্দা না করা, ৪. মালপত্র মসজিদে এনে বেচা-কেনা না করা।

যেসব কারণে ইতিকাফ ভেঙে যায় : ১. ওজরবশত বের হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিলম্ব করা, ২. বিনা ওজরে মসজিদের বাহিরে যাওয়া, ৩. স্ত্রী সহবাস করা, ৪. অসুস্থতা বা ভয়ের কারণে মসজিদ থেকে বের হয়ে যাওয়া।

ইতিকাফ অবস্থায় যেসব কাজ বৈধ : ১. মসজিদে পানাহার করা ২. শৌচকর্ম বা পেশাব-পায়খানার জন্য বাইরে যাওয়া ৩. ফরয গোসলের জন্য বাইরে যাওয়া ৪. জুমার নামাজের জন্য এতটুকু সময় নিয়ে বের হওয়া যাতে জামে মসজিদে গিয়ে খুতবার পূর্বে ২/৪ রাকাত সুন্নাত আদায় করতে পারে ৫. আজান দেওয়ার জন্য বাহিরে যাওয়া।

লাইলাতুল কদর প্রাপ্তি ও এ রাতের ঘোষিত ফজিলত লাভে ইতেকাফের চেয়ে উত্তম কোনো উপায় নেই। তাই এই সুযোগকে যথাযথ মূল্যায়ন করে যথাযথ কল্যাণ লাভে ধন্য হওয়া যাবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৪০, ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৫)

রাসুল (সা.) ইতিকাফ থাকাকালে আল্লাহর স্মরণে পূর্ণ মনোনিবেশ করতেন। তিনি সারাক্ষণ মসজিদে অবস্থান করতেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতেন না। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘যখন তিনি ইতিকাফে থাকতেন তখন প্রয়োজন ছাড়া বাসায় আসতেন না। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২০২৯)

একটি প্রচলিত ভুল : শরিয়ত মতে, পারিশ্রমিক দিয়ে ইতিকাফ করানো যায় না। কিছু এলাকায় দেখা যায়, রমজানের শেষ দশ দিনে এলাকার কেউ ইতিকাফ না করলে কোনো ব্যক্তিকে খাবার ও পারিশ্রমিক দিয়ে ইতিকাফ করানো হয়। কিন্তু এ নিয়মে ইতিকাফ করানো শুদ্ধ নয়। ইতিকাফ অবিনিময়যোগ্য একটি ইবাদত। তাই ইতিকাফের জন্য বিনিময় নেওয়াও জায়েয নেই।

গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির, ধর্ম ও সমাজ সচেতন লেখক, সাংবাদিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপস্থাপক, কুমিল্লা।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!