২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

খামে করে এলএসডি এসেছিল ছয়বার বিদেশি দামি মাদক নিয়ে নতুন শঙ্কা

অনলাইন ডেস্ক
দেশে বেশ আগে থেকেই ভয়ংকর মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড (এলএসডি) ব্যবহূত হয়ে আসছে। তবে উচ্চমূল্যের এই মাদক বেচাকেনার প্রক্রিয়া ইয়াবা, গাঁজা ও অন্যসব মাদকের চেয়ে একটু আলাদা। ফেসবুকে ‘ক্লোজ গ্রুপের’ মাধ্যমে এলএসডির গ্রাহক সংগ্রহ করে বিক্রেতারা। এই মাদকের গ্রাহক সাধারণত উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া সন্তানরা।

এলএসডি বাংলাদেশে প্রথম ধরা পড়ে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে। জড়িত দুই তরুণকে গ্রেপ্তারও করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। এভাবে দেশে এলএসডি ব্যবহারের বিষয়টি সামনে আসে।

প্রথম জব্দের পর এতদিন এলএসডি সম্পর্কে আর কোনো আলোচনা ছিল না। এক বছর ১০ মাস পর গত বুধবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ এলএসডি উদ্ধার ও তিন তরুণকে গ্রেপ্তারের পর বিষয়টি আবার সামনে এলো। গ্রেপ্তারকৃতরা নেদারল্যান্ডস থেকে খামে করে এই মাদক আমদানি করে। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছেন, এ পর্যন্ত এলএসডির অন্তত ছয়টি চালান এসেছে দেশে। ডিবি সূত্র জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকার করেছে দুই বছর ধরে তারা এলএসডি আমদানি করছে।

দেশে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদকের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলো রোধ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে বিদেশি নতুন ধরনের দামি মাদক এলএসডি প্রবেশ করায় নতুন শঙ্কা দেখা দিয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার সমকালকে বলেন, এলএসডি এখনও সেভাবে ছড়ায়নি। তবে এটি বন্ধ করতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। আমদানি রোধ করতে বিমানবন্দরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবেও এটি রোধ করতে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, কোনোভাবেই যেন নতুন ভয়ংকর এলএসডিসহ যে কোনো মাদক বিস্তার লাভ করতে না পারে, সেজন্য ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এক প্রবাসী বাংলাদেশির মাধ্যমে দেশে এলএসডি বেচাকেনার বিষয়টি জানতে পারে অধিদপ্তরের গোয়েন্দা বিভাগ। প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পারেন, গুলশান, উত্তরা ও কাফরুল এলাকায় এলএসডি ব্যবহার হচ্ছে। এর গ্রাহক উচ্চবিত্ত পরিবারের মাদকাসক্ত সন্তানরা। একটি ‘ক্লোজ গ্রুপের’ মাধ্যমে ওই মাদক কেনাবেচা হয়। এর পরই এই গ্রুপের সদস্য হন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই রাতে কাফরুল এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ মিলিগ্রাম তরল এলএসডি জব্দ করে ডিএনসির ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগ। ৪৬টি এলএসডি স্ট্রিপও জব্দ করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় দুই তরুণ ইয়াসের রিদওয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ আতিফ মাহমুদকে। তখন তাদের বয়স ২০ বছর। তাদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই কাফরুল থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী হয়েছিলেন ডিএনসির গোয়েন্দা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক ফজলুল হক খান। মামলাটি তদন্ত করেন পর্যায়ক্রমে দু’জন কর্মকর্তা।

ডিএনসির ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগের উপপরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, তদন্ত শেষে দুই তরুণকে অভিযুক্ত করে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন।

ডিএনসির বগুড়ার উপপরিচালক মেহেদী হাসান ঢাকা গোয়েন্দা বিভাগে সহকারী পরিচালক হিসেবে ২০১৯ সালের জুলাইয়ের ওই অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি জানান, গ্রেপ্তার ইয়াসের কানাডায় পড়ালেখা করতেন। গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েক মাস আগে কানাডা থেকে এলএসডি দেশে এনেছিলেন তিনি।

গত ১৫ মে রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে থেকে গলাকাটা অবস্থায় ঢাবির তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতেই মৃত্যু হয় তার। এ মৃত্যু নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। ডিবির রমনা বিভাগ হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করে।

তদন্ত করে গিয়ে সংশ্নিষ্টরা জানতে পারেন, হাফিজুর নতুন ধরনের মাদক সেবন করতেন। তখন আচরণও বদলে যেত তার। তার পরিচিত কয়েকজনের তথ্য পায় ডিবি। তারা এলএসডি বিক্রি ও সেবন করেন। গত বুধবার এলএসডি বেচাকেনায় জড়িত তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তূর্য (২২) এবং আদিব আশরাফকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ২০০ ব্লট এলএসডি উদ্ধার করা হয়। তারা ফেসবুক ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডির গ্রাহক সংগ্রহ করত। একটি গ্রুপের নাম ‘আপনার আব্বা’ এবং অপরটির নাম ‘বেটার ব্রাওরি অ্যান্ড বিয়ন্ড’। তাদের গ্রুপে সদস্য সংখ্যা এক হাজার- যারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দেশে প্রতি এলএসডি ব্লট বিক্রি হয় তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকায়।

গ্রেপ্তার তিনজনের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। তাদের রিমান্ড আবেদন করে গত বৃহস্পতিবার আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কাল রোববার রিমান্ড শুনানির দিন রয়েছে।

ডিবির রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার এইচএম আজিমুল হক বলেন, এলএসডি আমদানির জন্য টেলিগ্রামের অ্যাপসের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসে কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সাদমান সাকিব। অনলাইনভিত্তিক অর্থ লেনদেন (পেমেন্ট) ব্যবস্থা পেপ্যালের মাধ্যমে তিনি টাকা পাঠান নেদারল্যান্ডসে। এরপর কুরিয়ারে সাদমান সাকিবের নামে খামে করে সে দেশ থেকে এ দেশে এলএসডি আনা হয়। এলএসডির ব্লট পেপার ডাকটিকিটের মতো দেখতে।

ডিএনসির একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে এলএসডির প্রচলন না থাকলেও ১৯৯০ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ‘খ’ শ্রেণির মাদক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে এই মাদকও আসতে পারে- এমন আশঙ্কায় তখন এটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের আইনেও তা বলবৎ আছে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, ধাপে ধাপে বিভিন্ন নতুন মাদক প্রবেশে করেছে দেশে। আশির দশকে দেশে প্রথম ফেনসিডিল ও হেরোইন আসে। ১৯৯০ সালের দিকে প্রবেশ করে ইনজেকশন জাতীয় মাদক। ২০০০ সালের পর আসা শুরু করে ইয়াবা। ২০১৮ সালের দিকে নতুন মাদক হিসেবে বাংলাদেশে পাওয়া যায়- খাত। ক্রিস্টাল মেথ বা আইস নামের মাদকটি এসেছে কয়েক বছর আগে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নতুন মাদক হিসেবে পাওয়া যায় এলএসডি। এই মাদক সাদা, গন্ধহীন, তরল। এটি দানাদারও হয়। এটি ব্যয়বহুল এবং অতিরিক্ত ক্ষতিকারক। এলএসডিকে ‘সাইকাডেলিক’ মাদক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ মাদকের প্রভাবে মানুষ বাস্তবতাকে ভিন্নভাবে অনুভব করে। হ্যালুসিনেট বা অলীক বস্তুও প্রত্যক্ষ করে। এ মাদকের প্রতিক্রিয়া থাকে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা। তবে মাঝের দু-তিন ঘণ্টা খুবই বিপজ্জনক।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে মাদকবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্যমতে, রাসায়নিক সংমিশ্রণে এলএসডি তৈরি করা হয়। জার্মানির রসায়নবিদ আলবার্ড হোফম্যান ১৯৩৮ সালে ওষুধ হিসেবে এটি আবিস্কার করেন। তবে ক্ষতিকর হওয়ায় এটি নিষিদ্ধ করা হয়।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!