২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সমাজে পিতা-মাতারা অবহেলিত কেন

ধর্ম ও জীবন ডেস্ক।।
।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।
প্রত্যেকটি মানুষের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে স্বীয় পিতা-মাতাই সবচেয়ে বেশী শ্রদ্ধা-সম্মান এবং আদর-যত্ন পাওয়ার উপযুক্ত। হাদীসের ভাষ্য মতে পরকালীন মুক্তি ও জান্নাত লাভের জন্য পিতা-মাতার সন্তুষ্টি অর্জন একান্ত জরুরী। আল্লাহ্ তাআলা পিতা-মাতার হকের ব্যাপারে বান্দাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার মদীনায় স্বীয় দুধমাতা হযরত হালিমার সম্মানে দাঁড়িয়ে গিয়ে নিজের চাদর বিছিয়ে বসতে দেন।

দুধমাতার প্রতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত সম্মান বিবেচনা করলেই সহজে অনুমিত হবে যে, পিতা-মাতার হক কত বড়। আলোচ্য প্রবন্ধে আমি স্বীয় অভিজ্ঞতার আলোকে পিতা-মাতারা কেন অবহেলার শিকার হন তা নির্দিষ্ট করতে চেষ্টা করবো।

এ ব্যাপারে আমরা অনেকেই হয় তো ভেবে দেখি না যে, আমাদের সমাজে পিতা-মাতাকে অবহেলার যে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে, তা এক্ষুণি প্রতিরোধ করা না গেলে অচিরেই তারা তাদের ন্যূনতম মর্যাদাও হারিয়ে ফেলবেন। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন আমাদের বিদ্যমান পরিবার ও সমাজ ব্যবস্থা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে ও বহুবিদ মানবিক সংকট তৈরি হবে, অন্যদিকে সন্তানদের পরকালীন চিরস্থায়ী যিন্দেগীর মুক্তিও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এ ব্যাপারে আমাদের প্রত্যেককেই যত্নবান হওয়া জরুরী।

পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মৌলিক কতগুলো দায়িত্ব রয়েছে, যা পালন অপরিহার্য। এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ বা অমনোযোগী হলে নিশ্চিতঃ সন্তানকে আল্লাহ্ তাআলার দয়া থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পাঠক মহলের জ্ঞাতার্থে পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের মৌলিক করণীয় বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল।

(১) কথায়-কাজে এবং ব্যবহারে সর্বক্ষেত্রে পিতা-মাতার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে। তাদের খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা ও বিনোদনের সুন্দর ব্যবস্থা করা।

(২) পিতা-মাতা অন্যায়ভাবে কষ্ট দিলেও তাদেরকে প্রতিশোধমূলক কষ্ট দেওয়া যাবে না।

(৩) পিতা-মাতার আদেশ-নিষেধ অবশ্যই পালন করতে হবে। কিন্তু আল্লাহ্ এবং রাসূলের নাফরমানীমূলক আদেশের মান্যতা এর আওতাভুক্ত নয়।

(৪) পিতা-মাতা কাফির হলেও প্রয়োজনে তাদের ভরণ-পোষণ এবং খেদমত করতে হবে। কাফির বিবেচনায় তাদেরকে দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

(৫) পিতা-মাতা বেঁচে না থাকলে আজীবন তাদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে হবে। সামর্থ থাকলে তাদের উদ্দেশ্যে দান-খয়রাত করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে নফল ইবাদত, কুরআন তিলাওয়াত করে তাদের রূহে বখশে দিতে হবে।

(৬) পিতা-মাতার প্রিয়ভাজনদের সাথেও ভাল ব্যবহার করতে হবে। তাদের উপকার তথা খাওয়া-পরায় কষ্ট হলে সামর্থানুযায়ী সাহায্য করতে হবে।

(৭) পিতা-মাতার ঋণ পরিশোধ করতে হবে এবং জায়েয অসীয়ত পালন করতে সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে।

(৮) পিতা-মাতার ইন্তিকালের পর চিৎকার করে কাঁদা যাবে না। তাতে মরহুমের আত্মা কষ্ট পেয়ে থাকে। (বেহেশ্তি যেওর দ্রষ্টব্য)।

উপরোক্ত হকগুলো আদায়ে ব্যর্থ অথবা অমনোযোগী হলে নিশ্চিত সংশ্লিষ্টকে পরকালে হতাশ হতে হবে।

হযরত ইমাম বুখারী (রাহ্.) বাল্যকালে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মায়ের নেক দোয়ার বরকতে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সে দৃষ্টিশক্তি এতই তীক্ষ্ণ ছিল যে, চাঁদের আলোতেও তিনি পড়তে পারতেন। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাহ্.) একমাত্র মায়ের দোয়ার বরকতে ওলীকুলের সর্দার হয়েছিলেন। হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রাহ্.) মায়ের দোয়ার বরকতে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হয়েছিলেন। হযরত ওয়ায়েস করনী (রাহ.), যিনি মায়ের খেদমতের কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সময়ে দেখার দৌলত থেকে বঞ্চিত ছিলেন। স্বয়ং রাসূল (সা.) ওয়াসে কুরুনী (রাহ.)এর মায়ের খেদমতের বরকতের উল্লেখ করে বলেছিলেন, তাঁর দোয়া কবুল হবে এবং রাসূল (সা.) ইন্তিকালের পর কোন দোয়া কবুল হওয়ার জন্য ওয়াস করুনীকে দিয়ে যেন দোয়া করান। তাই সন্তানের উন্নতির জন্য পিতা-মাতার দোয়া অব্যর্থ মহৌষধ। অথচ আমরা অনেকেই এ ব্যাপারে বেখবর।

বর্তমান সমাজে দেখা যায়, অধিকাংশ সন্তান তাদের পিতা-মাতার অবাধ্য এবং পিতা-মাতা তাদের কাছে অবহেলার পাত্র। অনেক পিতা-মাতাই সন্তানের ব্যবহারে অতিষ্ঠ এবং ব্যথিত হয়ে যুগের/পরিবেশের উপর দোষ চাপিয়ে থাকেন। বাস্তবে এর জন্য যুগ বা পরিবেশ কিছুটা দায়ী হলেও সিংহভাগ দায়-দায়িত্ব পিতা-মাতার উপরই বর্তায়। প্রত্যেক পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করণার্থে যথেষ্ট চেষ্টা-তদ্বীর করে থাকেন কিন্তু পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর জন্য অনেক পিতা-মাতাই তেমন কোন পদক্ষেপ নেন না বললেই চলে।

আল্লাহ তাআলা সূরা তাহরীমের ৬ নাম্বার আয়াতে ঘোষণা করেছেন- “তুমি নিজে জাহান্নাম থেকে বাঁচো এবং তোমার আহ্ল (পরিবার-পরিজন)কে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। উক্ত আয়াতের আলোকে স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করা ফরয। আর এ ফরয আদায়ের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে- দুনিয়াবি শিক্ষার সাথে ধার্মিক রূপে গড়ে তোলা। এ ব্যাপারে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার এতটুকু সুযোগ নেই।

আমাদের সমাজে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষার দারুণ অভাব, তা অস্বীকার করা যাবে না। অধিকাংশ পিতা-মাতা এ ব্যাপারে ব্যর্থ। তাই তো সমাজ আজ কুপথে পরিচালিত হচ্ছে। কিছু লোক অবশ্য সন্তান-সন্ততিকে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শিখিয়েই মনে করেন সন্তানের দ্বীন শিক্ষা হয়ে গেছে। বাস্তবে একজন মানুষকে জীবন চলার পথে যাবতীয় বিষয়ে দ্বীনি জ্ঞান থাকা ফরয। আমার ধারণায় আধুনিক পরিবারের প্রায় সব পিতা-মাতা তাদের সন্তানকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছেন। অবশ্য মধ্যবিত্ত এবং নিম্নধ্যবিত্তদের কেউ কেউ স্বীয় সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করে এই হক আদায়ে তৎপর রয়েছেন। বাস্তবে দ্বীনি শিক্ষা না থাকার কারণে প্রিয় সন্তানেরা পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে অজ্ঞ। প্রকৃতপক্ষে যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের হক্ আদায়ে ব্যর্থ, তারা যে পিতা-মাতার হক্ব আদায়ে ব্যর্থ হবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।

আমাদের দেশে কিছুটা হলেও পিতা-মাতারা সম্মান-শ্রদ্ধা পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের চিত্তাকর্ষণকারী পাশ্চাত্য দেশসমূহে পিতা-মাতাদের অবস্থা খুবই করুণ। বৃদ্ধ বয়সে পাশ্চাত্যের পিতা-মাতারা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। সন্তানেরা যে যার মতে অন্যত্র চলে যায়, যা মারাত্মক কষ্টের ও অমানবিক।

ইসলাম পিতা-মাতার প্রতি সামান্যতম অনাদর-অবহেলাও পর্যন্ত অনুমোদন করে না। আমাদের সমাজ যেভাবে পাশ্চাত্যমুখী হতে শুরু করেছে, তাতে এ দেশের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকেও পাশ্চাত্যদের মত নিঃসঙ্গ জীবনে অচিরেই প্রবেশ করতে হবে। এ থেকে বাঁচতে হলে একমাত্র প্রতিষেধক হচ্ছে সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনি শিক্ষার ছোঁয়া লাগানো, আদর্শ ও সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং পাশ্চাত্য জীবন ধারা ও অপসংস্কৃতি থেকে সাধ্যমতো দূরে রাখতে সচেষ্ট থাকা।

তাই আসুন, আমাদের ভবিষ্যৎ অবসরকালীন জীবনের নিঃসঙ্গতা দূর করণের লক্ষ্যে সন্তানদেরকে দ্বীনি শিক্ষা প্রদানেও সচেষ্ট হই। আপনার সন্তানেরা আপনাকে অবহেলা করলে নিশ্চিতঃ তারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোন পিতা-মাতাই চান না যে, তাদের আদরের সন্তানেরা জাহান্নামী হোক। তাদেরকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা এবং স্বীয় মর্যাদা বহাল রাখতে পিতা-মাতাকে অবশ্যই তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষার ছোঁয়া লাগাতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। বিকল্প হতে পারে না।

আল্লাহ্ তাআলা মেহেরবানী করে আমাদের সবাইকে স্বীয় সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা প্রদানের তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: মহাপরিচালক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!