২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্যার চার্লস স্প্যান্সার চ্যাপলিন—প্লিজ রীড এভরিওয়ান

জুবায়ের জুবিলী

স্যার চার্লস স্প্যান্সার চ্যাপলিন—-
প্লিজ রীড এভরিওয়ান—-

লিমুজিনের দরজাটা খুলতে না খুলতেই ধেয়ে এল সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, ও ভক্তের সমুদ্র। সঙ্গে নামল প্রশ্নের ঢল।

“মিস্টার চ্যাপলিন, আপনি ইউরোপ কেন যাচ্ছেন?”

“আপনি কি ওখানে সিনেমা করবেন?”

“না।”

“আপনি আপনার পুরনো ছড়িগুলো কী করেন?”

“ফেলে দিই।”

“আপনি আপনার পুরনো জুতোগুলো কী করেন?”

“ফেলে দিই।”

টানা সাত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার রোদ ও জনপ্রিয়তার আগুনে দগ্ধ তিনি। হলিউডের কোলাহল ছেড়ে ঠিক করেছেন ছুটি কাটাবেন ইউরোপে। কিন্তু সবার আগে যাবেন এক দশক আগে ছেড়ে আসা নিজের শহর লন্ডন। যাত্রার আগের দিনটা ভেবেছিলেন নির্জনে প্যাকিং করবেন। কিন্তু ডাগ ও মেরি আমন্ত্রণ জানালেন তাঁদের ছবি ‘দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ -এর উদ্বোধনে। কাছের মানুষদের অনুরোধ ফেরাতে পারেন না তিনি।

জনসমুদ্র ঠেলে থিয়েটারের সামনে এগোবার চেষ্টা করলেন চ্যাপলিন। পারলেন না। ভিড়ের ঠেলায় তাঁর শখের টুপি ছিটকে গেল। সেটি কুড়োবার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে গেল ভক্তদের মধ্যে। অসহায় হয়ে ডাগ আর মেরিকে খোঁজার চেষ্টা করলেন তিনি। লক্ষ মানুষের ভিড়ে তখন তাঁরাও নিরুদ্দেশ। তাঁর জামা ধরে টানলেন এক ভক্ত। ছিটকে গেল বোতামগুলো, ছিঁড়ে গেল টাই, সুট, কলার।

ততক্ষণে পুলিশের হাত থেকে নিয়ে তাঁকে কাঁধে তুলে উল্লাস শুরু করেছেন কিছু মানুষ। অসহায় হয়ে দেখলেন, এক মহিলা ভক্ত কাঁচি দিয়ে কেটে নিচ্ছেন তাঁর প্যান্টের একটি অংশ! শেষমেশ জনতার কাঁধে চেপে কী ভাবে যেন পৌঁছে গেলেন থিয়েটারের গেটের কাছে।

এত কিছুর পরও তাঁর মুখে লেগে তাঁর বিখ্যাত ‘প্রপ স্মাইল’। আর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই আমেরিকা ছাড়বেন তিনি। তাই এ দেশের মানুষের পাগলামি হাসিমুখে মেনে নিলেন মেগাস্টার।

রাত একটা। অন্ধকার আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে ভেসে চলেছে প্রকাণ্ড বিলাসবহুল জাহাজ ‘অলিম্পিক’। নিজের কেবিনে একা বসে চ্যাপলিন। এখন তিনি একান্তই নিজের। টুপি, গোঁফ, ছড়িহীন চ্যাপলিন। বিছানায় পিঠটা এলিয়ে দিলেন। কাল সকালে ইংল্যান্ড পৌঁছবে অলিম্পিক। খবর পেয়েছেন, ঘরের ছেলেকে অভ্যর্থনা জানাতে বহু আয়োজন হয়েছে সেখানে।

লন্ডনের মেয়র থেকে ওয়েলসের যুবরাজ, সবাই মুখিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তার আগে কিছুটা ঘুমিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। ঘুমনোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু একটা শব্দ কানে এল।

কানে এল তাঁর নিজের নামটা। কান পাতলেন, কিছু শোনা গেল না। আবার কানে এল এক মহিলার কণ্ঠস্বরে গুনগুন করে একটা গানের সুর। জাহাজে আলাপ হয়েছিল এক অপেরা গায়িকার সঙ্গে। নিশ্চয়ই তিনি। তবে এত রাতে তো তাঁর গান গাওয়ার কথা নয়। শোনার ভুল নিশ্চয়ই। হঠাৎ বাতাসে হারিয়ে গেল সেই গলা। যেমন সে দিন স্টেজে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর মায়ের কণ্ঠস্বর।

মা হ্যানা চ্যাপলিন ছিলেন অপেরা গায়িকা। বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ হলেও, পাঁচ বছরের চার্লি ও ন’বছরের সিডনিকে নিয়ে সচ্ছল ছিল সুন্দরী হ্যানার পরিবার। কিন্তু ল্যারিঞ্জাইটিসের প্রকোপে দুর্বল হয়ে আসছিল তাঁর কণ্ঠস্বর।

একদিন স্টেজে গাইতে উঠেছিলেন মা। হঠাৎ গানের মাঝে গলা ভেঙে বিশ্রী সরু হয়ে গেল কণ্ঠস্বর। হাসাহাসি শুরু করলেন শ্রোতারা। কিছুক্ষণের মধ্যে তা পরিণত হল টিটকিরিতে। স্টেজ ছাড়তে বাধ্য হলেন মা।

স্টেজের পাশে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছিল পাঁচ বছরের চার্লি। উদ্বিগ্ন ম্যানেজার শ্রোতাদের মন ভোলাতে, ছোট্ট চার্লিকে তুলে দিলেন স্টেজে গান গাইতে। বেশ মজাই লাগছিল তার। স্টেজে উঠে মনের আনন্দে গান গাইতে শুরু করলেন। হাততালির ঝড় বয়ে গেল।

স্টেজের উপর পয়সা পড়তে লাগল বৃষ্টির মতো। ছোট্ট চার্লি গান থামিয়ে বললেন, ‘‘আমি আগে পয়সা কুড়োব, তার পর তোমাদের গান শোনাব’’। সেই শুনে আরও হাসিতে ভরে গেল হল। সে দিনটাই ছিল চার্লির প্রথম স্টেজ পারফর্ম্যান্স এবং তাঁর মায়ের শেষ।

গায়িকা হ্যানার অন্য কোনও কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই কাজও জুটল না আর। বসন্ত কেটে শীত আসতে না আসতেই ফুরিয়ে গেল জমানো টাকা। বন্ধক রাখতে হল গয়না। তিন বেডরুমের ঘর ছেড়ে দুই, তার পর তা ছেড়ে ৩ পাওনাল টেরাসের বস্তিতে এক চালাঘরে আশ্রয় নিল চ্যাপলিন পরিবার। সেলাইয়ের কাজ করে মা চালাতে থাকলেন সংসার।

তাতেও বাধা হয়ে দাঁড়াল অসহ্য মাইগ্রেনের যন্ত্রণা। প্রায়ই অন্ধকার ঘরে চোখে চা পাতার ব্যান্ডেজ জড়িয়ে শুয়ে থাকেন তিনি।

সে দিনও শুয়ে ছিলেন তাই। হঠাৎ বড় ছেলে সিডনি হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকল ঘরে। তার হাতে একটি পার্স। বাসে কাগজ বিক্রি করতে গিয়ে ওটা পেয়েছে সে। পার্সটা উপুড় করতেই বিছানায় পড়ল এক মুঠো রুপো ও তামার পয়সা। বেড়িয়ে পড়ল সাতটা সোনার মুদ্রা। চার্লি লক্ষ করলেন মা খুশি হয়েও, পরমুহূর্তেই চুপ করে গেলেন। শঙ্কিত হয়ে কী একটা খুঁজলেন পার্সটার মধ্যে।

ঈশ্বরবিশ্বাসী হ্যানা আশঙ্কা করছিলেন, ভিতরে কোনও ঠিকানা থাকলে ফিরিয়ে দিতে হবে সব কিছু। পার্সে ছিল না মালিকের ঠিকানা। শেষমেশ হাসি ফুটেছিল মায়ের মুখে। দুই ছেলেকে নতুন জামা কিনে দিলেন। তার পর বেড়াতে নিয়ে গেলেন সাউথএন্ড সি- তে। সেই চার্লির জীবনে প্রথম সমুদ্রদর্শন।

ছোট রাস্তা বাঁক নিয়ে যখন প্রথম দেখা গেল সমুদ্রটা, তাঁর মনে হয়েছিল সেটা যেন তাকে তাড়া করে আসছে। অবাক হয়ে দেখেছিলেন সৈকতের পাড়ে রঙিন ছাতা আর উলটানো নৌকোগুলো। খালি পায়ে তিনজনে হেঁটেছিলেন বালির উপর দিয়ে। ভিজে বালি, আর সমুদ্রের উষ্ণ ঢেউয়ে ক্ষণিকের জন্য ধুয়ে গিয়েছিল দারিদ্রের অনুভূতি।

ছোটবেলায় লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চার্লি দেখতেন, তৈরি হচ্ছে বিলাসবহুল রিৎজ হোটেল। সেই রিৎজ-এর বাইরে আজ লক্ষ মানুষ অপেক্ষারত তাঁর জন্য। হোটেলের ম্যানেজার নিজে তাঁকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেলেন। ঘর ভর্তি গোলাপের স্তবক আর শুভেচ্ছাবার্তা। হোটেলের নীচের রাস্তায় পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে জনসমুদ্র সামাল দিতে। পাশে বাড়িগুলো ঢাকা দৈত্যাকার সব প্ল্যাকার্ডে। বিশাল অক্ষরে লেখা ‘চার্লি অ্যারাইভ্স’।

বারান্দায় আসতেই তাঁকে দেখে উত্তাল হল জনতা, ‘‘গুড লাক চার্লি’’, ‘‘ওয়েল ডান চার্লি’’, ‘‘গড ব্লেস ইউ চার্লি’’। যেন বিশ্বজয় করে রাজা ফিরেছেন ঘরে। আনমনা হয়ে গেলেন চ্যাপলিন।

এত ভালবাসা কি তাঁর প্রাপ্য?

মাথা নত করে এই অভ্যর্থনা গ্রহণ করা ছাড়া যেন কিছুই করার নেই তাঁর।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!