২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৯ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাদারীপুরের ৫ তরুণের মৃত্যু, পরিবারে কান্না

👁️মহানগর অনলাইন ডেস্ক ✒️
সর্বশেষ ১৯ জুলাই তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুরে।

চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত অবৈধভাবে ইউরোপ যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে আট শতাধিক অভিবাসীর মৃত্যু হয়েছে।

ঝুঁকি জেনেও দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে ইউরোপ যাচ্ছেন তরুণেরা। বিপৎসংকুল সে যাত্রায় প্রায়ই ঘটছে প্রাণহানি। সর্বশেষ ১৯ জুলাই তিউনিসিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে ১৭ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুরে।

এই পাঁচজন হলেন রাজৈর উপজেলার আজিজ শেখের ছেলে জিন্নাত শেখ (২৫), বীরেন্দ্রনাথ মল্লিকের ছেলে সাধন মল্লিক (১৯), মোশাররফ কাজীর ছেলে হৃদয় কাজী (২১), আজিজুল শিকদারের ছেলে সাগর শিকদার (২২) ও মাদারীপুর সদর উপজেলার বাকির হোসেনের ছেলে মো. সাকিল (১৮)।

নিহত তরুণদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় তিন মাস আগে দালালদের মাধ্যমে লিবিয়া পৌঁছান তাঁরা। লিবিয়ায় আড়াই মাস একটি বন্দিশালায় আটকে থাকার পর তাঁদের ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। মাঝপথে সলিলসমাধি হয় তাঁদের।

স্বজনদের আহাজারি
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহতদের একজন হৃদয় কাজী (২১)। এসএসসি পাস করে হৃদয় পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন বাবার মুদিদোকানে। করোনায় সেখানে রোজগার কমে যায়। স্বজনেরা তাঁকে পাঠাতে চেয়েছিলেন ইতালিতে।

গত রোববার সরেজমিনে রাজৈর পৌরসভার ঘোসালকান্দি এলাকায় হৃদয়দের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে মেঝেতে বসে কাঁদছেন মা কোমেলা বেগম। গত শনিবার ছেলের মৃত্যুর খবরটি জেনেছেন তাঁরা। মুঠোফোনে সন্তানের সঙ্গে বলা শেষ কথাগুলো মনে করে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন কোমেলা। স্বজন ও প্রতিবেশীরা বাড়িতে ভিড় করছেন। আহাজারি করতে করতে কোমেলা বলছিলেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। তোমরা আমার বাজানরে আইনা দাও।’

হৃদয়ের বাবা মোশাররফ কাজী বলেন, ‘আমার পোলাডার এমন পরিণতি হবে জানলে কিছুতেই বিদেশ পাঠাইতাম না। দালালগো এত এত টাকা দিয়াও আমার পোলাডারে বাঁচাইতে পারলাম না।’

সাগরে ডুবে একই পরিণতি হয়েছে মাদারীপুর সদর উপজেলার কুচিয়ামোড়া গ্রামের শাকিলের (১৮)। একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বিলাপ করছিলেন মা রাজিয়া বেগম। বলছিলেন, ‘আমার সব তো শেষ হয়ে গেল। একমাত্র ছেলেডা আমারে রাইখা চইলা গেল। আমি আর বাইচা থাকব কার আশায়? তোমরা আমার ছেলেডারে শেষবারের মতো দেখাইয়া নাও।’

ধাপে ধাপে নেওয়া হয় টাকা
নিহত তরুণদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইতালি নেওয়ার কথা বলে অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণদের একেকজনের কাছ থেকে সাড়ে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নেয় দালালেরা।

বাংলাদেশ থেকে বাহরাইন হয়ে দুবাই নেওয়া হয় তরুণদের। দুবাইতে এক সপ্তাহ থাকার পর সেখানে থেকে নেওয়া হয় লিবিয়া। লিবিয়া পৌঁছানোর পর তরুণদের পরিবারের কাছ থেকে ইসলামী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দুই ধাপে প্রায় ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয়।

লিবিয়া পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তাঁদের একটি বন্দিশিবিরে আটকে রাখা হয়। এরপর আবারও ইসলামী ব্যাংকের আরও একটি অ্যাকাউন্টে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেওয়া হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়া থেকে সাগরপথে তাঁদের পাঠানো হয় ইতালিতে।

দেড় বছরে ৩৮ মামলা
মাদারীপুরের পাঁচটি থানায় গত দেড় বছরে মানব পাচার আইনে ৩৮টি মামলা হলেও দালাল চক্রের মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকেই আবার জামিনে বের হয়ে এই চক্রে জড়িয়ে পড়ছে।

জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, ৩৮টি মামলায় ১৯৬ জনকে আসামি করা হলেও পুলিশ মাত্র ৪২ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। এই ৩৮টি মামলার মধ্যে ২০টি মামলার বিষয় তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। ২০টির মধ্যে ১০টি মামলা আদালতেই নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি ১৮টির মধ্যে এখনো তদন্তাধীন আছে ৮টি মামলা। ১০টি মামলার অধিকতর তদন্ত করছে সিআইডি পুলিশ।

জানতে চাইলে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে তাদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হয় না। অভিযান চালিয়ে অভিযুক্তদের ধরা হয়। এরপরও প্রায়ই দেখা যায় ভুক্তভোগীরা মামলা দিতে আসতে চান না।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!