ইসলামের দৃষ্টিতে গীবত মারাত্মক ব্যাধি
ধর্ম ডেস্ক ✒️
আমরা নিজেকে যতই ভদ্রলোক প্রমাণের চেষ্টা করিনা কেন, নিজেকে যতই জ্ঞানী, শিক্ষিত দাবী করি না কেন, নিজেকে যতই সচেতন নাগরিক হিসাবে অহংবোধ করিনা কেন পরনিন্দা চর্চায় আমরা কিন্তু সবাই অভ্যস্ত। কেউ কম – কেউ বা বেশী।
পরনিন্দার আরবী শব্দ ‘গীবত’। অর্থাৎ অপরের দোষ খুঁজে বের করে অন্যকে বলা । কারো ব্যাপারে কোন কথা সত্য বা মিথ্যা হোক অন্য লোকের সম্মুখে প্রকাশ করলে যার সম্বন্ধে বলা হলো সে যদি অসন্তুষ্ট হয় তাহলে তাকে পরনিন্দা বলে। পরনিন্দা কবীরা গুনাহ।
এটা আমরা অনেকে জানার পরও পরনিন্দা করার স্বভাব থেকে নিজকে মুক্ত রাখতে পারি না। পরনিন্দা করার মধ্যে যেন একটা আলাদা আনন্দ। একটা অন্য রকম শান্তি। এক প্রকার জঘন্য লোকের এরূপ স্বভাব আছে তারা মানুষের পিছনে তার দোষের বিষয় অন্যের কাছে বাড়িয়ে বলে তৃপ্তি লাভ করে।
অবশ্য কোন কোন পরনিন্দাকারী এরূপও পাওয়া যায়-যারা নিজ থেকে কোন কিছু না বাড়িয়ে, না কমিয়ে মানুষের প্রকৃত দোষটুকু প্রকাশ করে দেয়। কিন্তু কথা হলো – মানুষের দোষত্রুটি তার অসাক্ষাতে অন্যের নিকট প্রকাশ করা, তা সত্য হোক আর মিথ্যা হোক দু’টোই পরনিন্দা। একদা নবী করিম (স.) সাহাবায়ে কেরামদের জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি জানো গীবত (পরনিন্দা) কি? সাহাবারা আরজ করলেন এ সম্পর্কে আল্লাহ এবং তার মনোনীত রসুল (স.)ই ভাল জানেন।
তিনি বললেন, তোমরা ভাইয়ের সম্বন্ধে এমন আলোচনা কর না, যা সে অপছন্দ করে। সাহাবারা আরজ করলেন যে বিষয়ের আলোচনা করা হয় তা যদি তার মধ্যে বিদ্যমান থাকে? তিনি বললেন, সে বিষয় তার ভিতর বিদ্যমান থাকলে এবং তা অন্যের কাছে বললেও তা গীবত হবে।
আর না থাকলে আরো বড় গুনাহ অর্থাৎ অপবাদ হবে। মানুষের দোষত্রুটির বিষয় তার অসাক্ষাতে আলোচনা করে তা দ্বারা ঐ ব্যক্তির কোন উপকার বা সংশোধন তো হয়ই না বরং ঐ স¤পর্কে তার পক্ষ থেকে কোন জবাব থাকলে তা প্রকাশের সুযোগ হয় না।
এতে ঐ লোক সম্পর্কে মানুষের ভ‚ল ধারণা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহতায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি গীবত করে সে যেন মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করে। পবিত্র হাদীস শরীফে আছে, গীবতকারীর পূণ্য যার গীবত করা হয়েছে তার নিকট চলে যায়, তার পাপ গীবতকারীর পাপের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হয়। কিছু মানুষ কুৎসা রটনা করে, পিছনে লেগে পড়ে, কারো অবর্তমানে তার সমালোচনা বা দোষ বর্ণনার মাধ্যমে পরনিন্দা করে।
এ পরনিন্দা মানুষ কেন করে তার কারণ জানতে হলে দেখা যায় নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অপরের নিকট প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করা। হিংসার কারণে কেউ পরনিন্দা করে থাকে। কারো উন্নতি কিংবা ভালো দেখে অথবা মানুষকে তার সম্মান ও প্রশংসা করতে দেখে অন্য কিছু করতে না পেরে তার দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে যাতে মানুষ তার প্রতি বিরাগভাজন হয়ে তার সম্মান ও প্রশংসা করা থেকে বিরত থাকে। আগে থেকে যদি কেউ বুঝতে পারে যে অমুক ব্যক্তি তার সম্পর্কে অমুক ব্যক্তির কাছে তার দোষ প্রকাশ করবে তখন সে পূর্বে তার পরনিন্দা করে সে ব্যক্তিকে তার প্রতি বিষিয়ে তোলে, যাতে তার কথা ঐ ব্যক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য না হয়।
কেউ কারো দেখাদেখিতে তাল মিলাতে গিয়েও পরনিন্দা করে। নিজের সঙ্গী কারো সম্পর্কে কেউ মন্দ আলোচনা করলে তখন সে নিজেও তার বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে অথবা সে তার উপর নারাজ হবে এ ভয়ে তারা পরনিন্দাকে সমর্থন করে। কেউ কেউ কোন কারণ ছাড়াই কারো প্রতি অপরের মন বিষিয়ে তোলার জন্য দোষ বর্ণনা করে। মনে রাখতে হবে, কারো প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা তার কার্যকলাপ নিয়ে হাসাহাসি করাও পরনিন্দা।
কারো দৈহিক, চারিত্রিক, বংশগত, পেশাগত, ব্যক্তিগত ত্রুটি অথবা কাজ, আচার-আচরণের কথা বর্ণনা করা অথবা নিন্দা করাও পরনিন্দা। আবার এটা শুধু মুখে বলার উপর নির্ভর করে না বরং আকার ইঙ্গিতে অপরের দোষ প্রকাশ করাও পরনিন্দা।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা এক মহিলা রসুল (স.) এর কাছে আগমন করলো, যখন সে চলে গেলো তখন আমি বললাম, যে মহিলাটি এখানে এসেছিল সে বেঁটে। রসূল (স.) বললেন, তুমি গীবত করলে। হাদীস শরীফে এসেছে শ্রোতা ও পরনিন্দাকারীদের একজন কোন জ্ঞানী, গুণী, বিদ্বান, ঈমাম, কামেল, ফাজেল অথবা যে কোন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তির কাছে কারো সম্পর্কে নিন্দা করছে, তিনি কোন প্রকার বাঁধা প্রদান না করে নীরবে শুনতেন, কোন প্রতিবাদ করতেন না। কারণ পরনিন্দা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করাও পরনিন্দা এতে পরনিন্দাকারী আরোও উৎসাহিত হয়।
পরনিন্দা যে ব্যভিচারের চেয়ে জঘন্য এ সত্যটি যাদের জানা নেই তারা এ জঘন্য কাজটি করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যারা পরনিন্দা সম্পর্কে, পরনিন্দার কুফল বা ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে অবগত আছেন তাদেরও দেখি এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সতর্কতা নেই। কেউ কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করে পরনিন্দা করেন, কেউ হিংসার বশবর্তী হয়ে, কেউ তার স্বার্থের উপর আঘাত হওয়ার সাথে সাথে পরনিন্দায় লিপ্ত হন।
অনেকে কারো জ্ঞান, প্রতিভা, মেধাকে সহ্য করতে না পেরে অন্যদেরকে তার নিন্দার মাধ্যমে নিজের হিংসার যন্ত্রণাকে লাঘব করার প্রয়াস চালায়। অনেককে দেখি কারো “মত” ও আদর্শের পরিপন্থী হলে পরনিন্দা করতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করে না। কেউ শিক্ষা, জ্ঞান, প্রতিভা, মানে, গুণে, সম্মানে অনেক নিম্ন পর্যায়ের মানুষ হওয়া সত্বেও বা সমাজের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা না থাকা সত্বেও, কারো সহযোগিতায় উপরের সারিতে চলে আসার সুযোগ হলে এরা সত্যিকার শিক্ষিত, জ্ঞানী, গুণী, প্রতিভাবান, ব্যক্তিদের নিন্দায় তৎপর হয়ে উঠে।
এ সব জঘন্য চরিত্রের লোকেরা কখনো কখনো এমন বলে বসে, অমুক ব্যক্তিতো এ সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ, ওর চেয়ে আমি অনেক বেশী জ্ঞানী। অনেকে বুঝতে পারে না এরা নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য এ ধরণের ঘৃণ্য তৎপরতা চালায়। আবার কেউ কেউ বলে অমুক এরকম কাজ করেছে, অথচ খবর নিয়ে দেখা যায়, বক্তব্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইহা কি উচিত?।
অনেক লোকের মধ্যে আবার এরূপ স্বভাব দেখা যায়, যারা লজ্জ্বা দেওয়ার জন্য কারো দোষত্রুটির বিষয় লোকের সম্মুখে তাকে বলে এবং এভাবে বলে সে গর্বানুভব করে। এটা কিন্তু পরনিন্দার মতো একটি দোষের বিষয়। কারণ মানুষকে এভাবে লজ্জা দেয়া কোন ক্রমে উচিৎ নয়। রসুল আকরাম (স.) বলেন, “তুমি যদি মোমেন, মুত্তাকীর দোষকে গোপন করতে না পারো, আল্লাহও কিয়ামতের দিন তোমার দোষকে গোপন রাখবেনা।” (চলবে)