নানা উদ্যোগের পরও ঠেকানো যাচ্ছে না ঘরে ফেরা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এবার ঈদুল ফিতরের ছুটিতে সরকারি-বেসরকারি চাকুরেদের কর্মস্থলে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু গত কিছুদিন ধরে ঘরমুখো মানুষের ঢল থামানো যাচ্ছে না। এমনকি ফেরিতে হুড়োহুড়িতে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
দূরপাল্লার বাস, ট্রেন ও লঞ্চ বন্ধ থাকলেও সরকারের দুর্বল তদারকি ও নির্দেশনার অস্পষ্টতায় মানুষকে কর্মস্থলে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাই লকডাউনসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও আগামী দিনগুলোতে করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে বৃহস্পতি বা শুক্রবার (১৩ বা ১৪ মে) দেশে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে। যদিও করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ (লকডাউন) চলছে এখন। লকডাউন বহাল থাকবে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত।
গত ৫ মে সর্বশেষ বিধিনিষেধ বাড়িয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি অফিস এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঈদের ছুটিতে আবশ্যিকভাবে নিজ নিজ কর্মস্থলে (অধিক্ষেত্রে) অবস্থান করবেন।
একই সঙ্গে মানুষের চলাচল ঠেকাতে আন্তঃজেলা গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে। বন্ধ আছে ট্রেন ও লঞ্চ। মানুষকে কর্মস্থলে রাখতে ঈদের ছুটি কমিয়ে ২৯ রমজানেও অফিস খোলা রেখেছে সরকার।
সরকারের পক্ষ থেকে ঈদে তিনদিনের বেশি ছুটি দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও ছুটি বাড়াতে আন্দোলনে নামেন পোশাকশ্রমিকরা। আন্দোলনের মুখে ঈদের ছুটি বাড়িয়ে দিচ্ছেন কারখানার মালিকরা। জানা গেছে, অধিকাংশ পোশাক কারখানাই ৫ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত ছুটি দিয়েছে।
গত কিছুদিন থেকেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করে মানুষ। জেলার মধ্যে চলাচল করা বাসের মাধ্যমে মানুষ চলে যাচ্ছেন ফেরিঘাটগুলোতে কিংবা জেলার প্রান্তে। ফেরি পার হয়ে কিংবা গাড়ি পাল্টে পৌঁছে যাচ্ছেন গন্তব্যে।
কিন্তু ব্যক্তিগত গাড়িতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে কোনো কিছু বলা নেই সরকারের প্রজ্ঞাপনে। তাই অনেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে বা প্রাইভেটকার নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন ঈদ উদযাপনের জন্য। চালু আছে বিমান যোগাযোগও। লুকিয়ে আন্তঃজেলা বাস চালাচলেরও খবর আসছে গণমাধ্যমে। ট্রাক, কাভার্ডভ্যানসহ পণ্যবাহী বিভিন্ন গাড়িতেও রাজধানী ছাড়ছেন অনেকে।
মানুষের চলাচল ঠেকাতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও শিমুলিয়া-বাংলাবাজার রুটে ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলেও পরে মানুষের চাপে সেই সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেনি সরকার।
বুধবার (১২ মে) প্রচণ্ড ভিড়ে ফেরিতে করে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে মাদারীপুরের বাংলাবাজারে যাওয়ার পথে হুড়োহুড়িতে ছয়জন মারা গেছেন। এ ঘটনায় অসুস্থ হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক।
এ বিষয়ে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহিদুল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানুষকে কর্মস্থলে আটকে রাখা যাচ্ছে না। মানুষ যেভাবে গাদাগাদি, হুড়োহুড়ি করে যাচ্ছে, তাতে তো স্বাস্থ্যবিধি মানা হলো না। কারো কারো মুখে মাস্ক নেই। এর মধ্যে একজনের সংক্রমণ থাকলে তিনি তা ছড়াবেন। যারা আক্রান্ত হবেন তারা আবার অন্যদের সংক্রমিত করবেন।’
তিনি বলেন, ‘তাই আমাদের ধারণা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির পর চলতি মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের শুরুর দিকে করোনা সংক্রমণটা আবার বাড়তে পারে।’
কারিগরি কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘শহর ছেড়ে গ্রামে ঈদ করতে যাওয়া ঠেকাতে সরকারের তদারকি ব্যবস্থা দুর্বল। বিভিন্ন বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানানোর পর্যাপ্ত লোকবল নেই সরকারের। আর গাড়ি চলাচলের বিষয়ে নির্দেশনাটাও আরও স্পষ্ট হওয়ার দরকার ছিল। দূরপাল্লায় চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া যেত।’
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, যে যেখানে কাজ করেন সেখানেই থাকবেন। কেউ স্টেশন লিভ করতে পারবেন না। যারা যাচ্ছেন, তারা সবাই চাকরি করেন তা নয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা ৮০ শতাংশের বেশি মানুষকে মাস্ক পরাতে সফল হয়েছি। আমরা মানুষকে যেখানে আছে সেখানে রাখতেও সক্ষম হয়েছি। তবে কিছু মানুষকে কখনই কোনো কিছু মানানো সম্ভব নয়। তারা অবুঝ।’
‘যারা যাচ্ছেন বুঝতে পারছেন না যে, তিনি তার মায়ের জন্য করোনা নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি তার প্রিয় মাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারেন।’
শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে ছুটি বাড়ছে- এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘মালিকরাও ছুটি বাড়াতে চান। আমরা মানুষের কল্যাণ চাচ্ছি। একটা ওয়ার লাইফ সিচুয়েশন বিরাজ করছে এখন। ভারতের অবস্থাটা দেখেন। নদীতে লাশ ভেসে আসছে। সন্তান তার পিতাকে দাফন করতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই সিচুয়েশনে সকলে আমাদের সহযোগিতা করুক। কিন্তু কিছু সংখ্যক লোক আছে কখনও কিছু শুনবেই না।’
ব্যক্তিগত গাড়িতে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যাওয়ার বাধা নেই- এ বিষয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘নেগেটিভ মার্কেটিং বলে একটি বিষয় আছে। জেলার মধ্যে গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর মানুষের চলাচল বেড়ে গেল। আর দূর পাল্লার গণপরিবহন ছেড়ে দিলে তখন কী হতো? এখন হয়তো এভাবে কিছু যাচ্ছে।’
‘ব্যক্তিগত গাড়িতে যাওয়া তো ব্যয় বহুল। আমরা তো মানুষকে স্থানান্তরে নিরুৎসাহিত করছি। নেগেটিভ মার্কেটিং করে আমরা বলতে চাচ্ছি, আপনি কর্মস্থলেই থাকুন, এটাই আপনার জন্য ভালো।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আগে ট্রেনগুলো ভরে, লঞ্চ ভরে, দূর পাল্লার বাসগুলো ভরে মানুষ গ্রামে যেতেন, এবার সেটা হচ্ছে না। আমি বলব ৯০ শতাংশ মানুষ আমাদের আহ্বানে সারা দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ঈদের সময় স্টেশন লিভ করব না। আমি ঢাকাতেই আছি। আমি আমার এলাকার জনগণকে বলেছি, যে যার জায়গায় থাকেন। যে কোনো কাজে ডিজিটালি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’