নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ ও কবর জিয়ারত সম্পর্কে ইসলামের বিধান
ধর্ম ও জীবন ডেস্ক।।
অনেক সময় দেখা যায়, নারীরা জানাযার নামাজে অংশ না নিলেও লাশের সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হয়ে হয়ে কবরস্থান পর্যন্ত যান। নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ বিষয়টি নিয়ে সকলের মাঝেই এক ধরনের আবেগ কাজ করে।
বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাখ্যা করে এভাবে লাশের সঙ্গে নারীদের যাওয়ার পক্ষেও মতপ্রকাশ করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলাম নারীদেরকে এভাবে লাশের সঙ্গে বা নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ করার বা লাশ দাফনে কবরস্থান পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয় না।
নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ
এটি ইসলামের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত যে, নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ ও নামাজে অংশগ্রহণ করা জায়েজ নেই। এমনকি দাফনের জন্য লাশের সঙ্গে যাওয়াও তাদের জন্য নিষিদ্ধ। নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর সাহাবী ও ইসলামের বড় আলেমদের নিকট থেকেও এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম একটি জানাযার সঙ্গে ছিলেন। হঠাৎ তিনি দেখলেন যে, একজন বৃদ্ধ মহিলাও জানাযার সঙ্গে সঙ্গে আসছে। এটা দেখে তিনি ক্রোধান্বিত হলেন এবং তার মুখমণ্ডল ক্রোধে লাল হয়ে উঠল। তখন তার নির্দেশে ওই বৃদ্ধা মহিলাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো।
এরপর যখন খাটিয়া সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে রাখা হল তখনও তিনি জানাযা শুরু করলেন না। লোকেরা তাঁকে বলল, ঐ সত্তার শপথ! যিনি আপনাকে হকসহ প্রেরণ করেছেন। ঐ মহিলা তো শহরের বাড়িঘরের আড়াল হয়ে গেছে। এরপর তিনি জানাযার তাকবির দিলেন। (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)
উম্মে আতিয়্যা (রাযিঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে (মেয়েদেরকে) জানাযার জন্য বের হতে নিষেধ করেছেন। (তাবারানি)
আমর ইবনে কায়স (রহ.) বলেন, আমরা এক জানাযায় উপস্থিত ছিলাম। আবু উমামা (রাযিঃ)-ও সেখানে ছিলেন। তিনি দেখলেন জানাযার নামাজ আদায়ের জন্য কিছু মহিলা এসেছে। তখন তিনি তাদেরকে সেখান সরে যেতে বললেন। (ইবনে আবি শাইবা)
এছাড়া, আমাদের আকাবীর ওলামায়ে কেরামগণ ঐ জানাযা পড়তেন না, যে জানাযায় কোনো নারী উপস্থিত থাকত।
নারীদের জন্য জানাযায় অংশগ্রহণ বিষয়ে আলেমদের বক্তব্য
বিখ্যাত আলেম শাবি (রহঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, নারীরা কি জানাযার নামাজে শরীক হবে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “না, নারীরা জানাযার নামাজে শরীক হইবে না, চাই সে পবিত্র হোক কিংবা মাসিক অবস্থায় থাকুক।” (মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামের উপরোল্লেখিত হাদিস এবং সাহাবা-তাবেয়িনের আমল ও ফাতওয়া থেকে আশা করি পাঠকের নিকট এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, নারীদের জন্য জানাযার উদ্দেশ্যে বের হওয়া জায়েজ নয়।
নারীরা ঘরে অবস্থান করেই মৃতের জন্য ঈসালে সওয়াব ও মাগফিরাতের জন্য দু’আ করবেন। তাদের জন্য এ আমল করাই ইসলামের নির্দেশ।
নারীদের জন্য কবর জিয়ারত
মন নরম করা, আখিরাতের স্মরণ বৃদ্ধি করা এবং দুনিয়ার সম্পদ, খ্যাতি ও লোভ হ্রাস করার পেছনে কবর জিয়ারতের শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লামও আমাদের জন্য কবর জিয়ারতকে সুন্নত আমল শিখিয়ে গিয়েছেন।
তবে কবর জিয়ারতের এই আমল কি শুধু পুরুষের জন্যই সুন্নত? নাকি পুরুষদের মত নারীদের জন্যও সুন্নত- এটা নিয়ে সমাজে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে। সেই সঙ্গে সমাজে কিছু প্রান্তিকতাও দেখা যায়। যার কোনোটিই সমর্থনযোগ্য নয়।
নারীদের কবর জিয়ারত প্রসঙ্গে বিপরীতমুখী দু’ধরণের হাদিস পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম কবর জিয়ারতকারী নারীদের ওপর অভিশম্পাত করেছেন।” (তিরমিযী)
বর্ণিত হাদিসের বিপরীতেও হাদিসের বর্ণনা পাওয়া যায়। আলী (রাযিঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবীজীর কন্যা ফাতেমা (রাযিঃ) প্রতি জুমার দিন তার চাচা হজরত হামজা (রাযিঃ)-এর কবর জিয়ারত করতেন। তিনি সেখানে নামাজ পড়তেন এবং দু’আর ভিতর কান্নাকাটি করতেন। -(মুস্তাদরাকে হাকিম)
হাদিসের ব্যাখ্যা
কবর জিয়ারত নিয়ে এমন বিপরতমুখী দু’ধরণের হাদিসের সুন্দর ব্যাখা করেছেন অনেক ওলামায়ে কেরাম আরেকটি হাদিসের আলোকে। তাঁদের মতে, “যে হাদিসে কবর জিয়ারতকারী নারীদের উপর অভিশম্পাত করা হয়েছে; ঐ হাদিসটি হল ইসলামের প্রথম যুগের। সে সময় কবর জিয়ারত ইসলামে নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে যখন নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিয়ে কবর জিয়ারতের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে তখন সে অনুমতি নর-নারী নির্বিশেষে সবার জন্যই দেওয়া হয়েছে।”
এ কারণেই আমরা দ্বিতীয় হাদিসে দেখতে পাচ্ছি, স্বয়ং নবীজীর কন্যা ফাতিমা (রাযিঃ) প্রতি জুমার দিন নিজের চাচার কবর জিয়ারত করতেন। নবীজীর কন্যার মত তাঁর স্ত্রী হজরত আয়েশা (রাযিঃ)-ও কবর জিয়ারত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আবি মুলাইকা(রহঃ) বলেন, “একদিন আয়েশা (রাযিঃ)-কে কবরস্থান থেকে আসলেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কোথা থেকে আসলেন? তিনি বললেন, আমি আমার ভাই আবদুর রহমানের কবরের নিকট থেকে আসলাম।” তখন আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “নবীজী কি কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেননি?” তিনি উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, (ইসলামের প্রথম যুগে) নবীজী কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে কবর জিয়ারতের আদেশ করেছেন।” (বাইহাকি)
সুতরাং, সারকথা হল, পুরুষদের মতো নারীরাও কবর জিয়ারত করতে পারবেন। তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, শরয়ি পর্দার পূর্ণ অনুগামী হয়ে পুরুষদের সংশ্রব ও সংমিশ্রণ এড়িয়ে এবং কবরের পাশে উচ্চ স্বরে বিলাপ বর্জন করে যদি কোনো নারী কবর জিয়ারত করতে আগ্রহী হয় তবে তার জন্য ইসলামে বিধিনিষেধ নেই।