২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ১ হাজার ৪৪০ মিনিট

✒️ নিউজ ডেস্ক
বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই), ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল ৫টা। হাসেম ফুড আ্যান্ড বেভারেজে বিশাল কারখানাটির সকালের শিফটের শ্রমিকরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাড়ি ফেরার। শেষবারের মতো গুছিয়ে নিচ্ছেন কাজের যন্ত্রগুলো। এরই ফাঁকে চলছে বকেয়া বেতন আর ঈদ বোনাস নিয়ে কথা। এই শ্রমিকদের ৮০ শতাংশ কিশোরী। কারো বয়স ১৩ থেকে শুরু হয়েছে, বেশিরভাগেরই থেমেছে ১৬ এর কোঠায় এসে। রূপগঞ্জ, ভুলতাসহ নারায়ণঞ্জের আশপাশের এলাকা থেকে এসে কারখানাটিতে কাজ করছেন তারা। মাসিক বেতনের শুরু ৩ হাজার থেকে।৫টা ৫ মিনিট: দ্বিতীয় তলার সেজান জুস তৈরির ফ্লোর থেকে ভেসে আসে আগুন! আগুন! চিৎকার। সে সময় সেখানে কাজ করছিলেন বেলা ১২টা থেকে আসা মিড শিফটের ৪৭ জন কিশোরী ও নারী।

৫টা ১০ মিনিট: ভবনটিতে কোনো ফায়ার অ্যালার্ম বেজে উঠল না। তাই আগুনের কথা উপরের তলার ফ্লোরের শ্রমিকদের তখনও অজানা। দ্বিতীয় তলার লাইনম্যান সেখানকার কয়েকজন কিশোরী শ্রমিক নিচে নামতে গেলে তাদের বাধা দেন। তাদেরসহ বাকিদের নিয়ে চলে যান ভবনের ৪ তলার নুডুলস ও সেমাই তৈরির ফ্লোরে। শ্রমিকদের বলা হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুন নিভে যাবে। ভয়ের কিছুই নেই। তবে এরইমধ্যে একজন শ্রমিক মোবাইল ফোনে তার ভাইকে জানান কারখানায় আগুন লেগেছে।

৫টা ২০ মিনিট: দ্বিতীয় তলার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। ছড়িয়ে পড়েছে ভবনের উপরের তলাগুলোতেও। আতঙ্কিত হয়ে শ্রমিকরা সিঁড়ি নিয়ে নামতে চেষ্টা করেন। কয়েকজন জীবন বাঁচাতে লাফ দেন নিচে।

৫টা ৪২ মিনিট: আগুনের তীব্রতা আরও বাড়ে। এরইমধ্যে কারখানার সামনে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট।

সন্ধ্যা ৬টা: বিভিন্ন তলা থেকে লাফ দেওয়া প্রায় ২৫ জন শ্রমিককে কারখানার সামনের খোলা জায়গা থেকে উদ্ধার করেন দমকল কর্মীরা। গুরুতর অবস্থায় ৬ শ্রমিককে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

সন্ধ্যা ৭টা: অফিস শেষ হবার পরও সন্তান ঘরে না ফেরায় অনেকে আসেন কারখানার সামনে। দূর থেকেই দেখেন আগুনের লেলিহান শিখা, খবর পান আগুন লাগার।

সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট: সকাল সকালেই সবাই বাড়ি যাবে, আগুনও নিভবে একটু পর। কারখানার সুপারভাইজার এমন আশ্বাস আর অনেকটা ধমকে বাড়ি পাঠিয়ে দেন শ্রমিকদের স্বজনদের।

রাত ৮টা: আগুন নেভাতে যুক্ত হয় ফায়ার সার্ভিসের আরও ৮টি ইউনিট। ১৫ ইউনিট একযোগে আগুন নেভানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে।

রাত ১১ টা: ঢাকা মেডিকেল কলেজে গুরুতর আহত শ্রমিক মোরসালিনকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

রাত ১২ টা: প্রথম সংবাদ সম্মেলনে কারখানার ভেতর থেকে তিনজন কিশোরী শ্রমিক মারা গেছেন বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক দেবাশীষ মন্ডল।

রাত ১টা থেকে শুক্রবার ভোর ৬টা: একটানা চলে ফায়ার সার্ভিসের কারখানার উপর পানি ছিটানোর কাজ।

শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টা: দাউ দাউ জ্বলতে থাকা কারখানার সামনে ভিড় জমাতে শুরু করেন বাড়ি না ফেরা কয়েক হাজার শ্রমিক। আগুনের ভয়াবহতা দেখে শুরু হয় স্বজনদের আর্তনাদ, আহাজারি। সন্তান কোলে নিয়ে ছুটে আসেন অনেক মা, হাজির হন বৃদ্ধ পিতা, অল্পবয়সী ভাই ও বড় বোন। কারখানার সামনের রাস্তা, প্রধান গেট ও পেছনের মাঠে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকেন।

সকাল ৮টা: ঢাকা থেকে আসা আরও ২টি ইউনিট যুক্ত হয় আগুন নেভানোর কাজে। শুরু হয় একযোগে ১৭টি ইউনিটের কাজ।

সকাল ৯টা: ১৬ ঘণ্টাতেও আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনরা। আগুন থেকে বেঁচে ফেরা শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, ‘আগুনের জন্য কারখানার কর্তৃপক্ষই দায়ী’। কারণ এখানে কোনো ফায়ার অ্যালাম ছিল না, ছিল না ফায়ার এক্সটিংগুইশার। এমনকি শ্রমিকদের বের হবার ও ঢোকার পথ মাত্র একটি। উপরের ফ্লোরগুলোতে প্রতিনিয়ত হুক রোপ দিয়ে পণ্য পরিবহন করলেও, উপরে আটকা পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারে সেই দড়িগুলোও কেউ ব্যবহার করেনি। ব্যবহার হয়নি কারখানার গোডাউনে পড়ে থাকা মইগুলো। এমনকি লাইনম্যান ও ফোরম্যান অনেক শ্রমিককে আগুন লাগার পর ৪ তলায় নিয়ে আটকে রাখার অভিযোগও তোলেন।

সকাল ৯টা ৪৮ মিনিট: ঘটনাস্থলে আসেন বিসিআইসির ২ সদস্যের পরিদর্শক কমিটি।

সকাল ৯টা ৫৪ মিনিট: বিসিআইসি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান জানান, ‘কারখানার ৫ তলায় রাসায়নিকের গুদাম ছিল, নিচতলায় পলিথিন তৈরি করা হতো। প্রচুর পরিমাণ কেমিক্যালের উপস্থিতির কারণেই দীর্ঘ সময়েও আগুন নেভানো যাচ্ছে না। একই কারণে ভবনটির আগুন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

সকাল ১০টা ১ মিনিট: আগুন নেভাতে যুক্ত হয় ফায়ার সাভিসের আরও একটি ইউনিট। ১৮ ইউনিটের একযোগে শুরু হয় পানি ছিটানো।

সকাল ১০টা ৩১ মিনিট: দ্বিতীয় সংবাদ সম্মেলনে ফায়ার সাভিসের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিষয়ক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সিদ্দিক মো. জুলফিকার রহমান সংবাদমাধ্যমকে জানান, ৬ তলা ভবনের কারখানটির ভেতরে শ্রমিকদের বের হবার তেমন কোনো এক্সিট পথই ছিল না। তাই বের হতে না পেরে আগুনে অনেক শ্রমিকই ভবনটির ভেতরে আটকা পড়েছেন।

সকাল ১০টা ৩৭ মিনিট: ঘটনাস্থলে পৌঁছে র‌্যাব-১১ এর টিম।

সকাল ১১টা বেজে ১২ মিনিট: ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান।

সকাল ১১টা ৩ মিনিট: পুলিশ শ্রমিকদের বিক্ষোভে বাধা দিলেও ফের সংঘর্ষ শুরু। ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, তাদের নিবৃত্ত করতে পুলিশের টিয়ারশেল নিক্ষেপ।

দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট: ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলার আগুন তখনও জ্বলছে।

দুপুর ২টা ২ মিনিট: দীর্ঘ ২১ ঘণ্টা পর কারখানার আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।

দুপুর ২টা ২২ মিনিট: কারখানার ৪ তলা থেকে ৪৯ জন হতভাগ্য শ্রমিকের মরদেহ উদ্ধার কথা জানিয়ে ফায়ার সাভিসের তৃতীয় সংবাদ সম্মেলন। ৫ম ও ৬ষ্ঠ তলায় পর্যায়ক্রমে উদ্ধারকাজ চালানোর ঘোষণা।

দুপুর ২টা ৩০ মিনিট: উদ্ধারকাজে বিরতি।

বিকেল ৪টা ১২ মিনিট: ঘটনাস্থলে যান সিআইডি ও পিবিআইয়ের পৃথক ক্রাইম সিন ইউনিট।

বিকেল ৫টা: ঘটনাস্থল পরিদর্শনে র‌্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!