জেনে নিন নারীদের সেজদার সঠিক পদ্ধতি
ধর্ম ও জীবন ডেস্ক।।
নামাজ ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। নারী-পুরুষ সবার জন্যই নামাজ ফরজ। একজন মুমিন ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে, দেশে-বিদেশে, সাগরে-মহাকাশে যেখানেই অবস্থান করে, তাকে নামাজ পড়তেই হবে। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘…নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্যকর্তব্য।’ (সুরা নিসা: ১০৩)
নারী-পুরুষের নামাজে পদ্ধতিগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে। বিষয়টি নবীজির হাদিস দিয়েই প্রমাণিত। এটি প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে চলমান পার্থক্য। এই বিষয়ে চার মাজহাবের ইমামগণ একমত। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িনদের ফতোয়াও একই।
একবার রাসুলুল্লাহ (স.) দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্য) বললেন-‘যখন সেজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিলিয়ে দিবে। কেননা মহিলারা এক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। (বায়হাকি: ৩০১৬, কিতাবুল মারাসিল লি ইমাম আবু দাউদ: ৫৫, হাদিস: ৮০)
প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আলেম নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আওনুল বারি’ (১/৫২০) তে লিখেছেন-‘উল্লেখিত হাদিসটি সকল ইমামদের উসুল অনুযায়ী দলিল হিসেবে পেশ করায় যোগ্য। মুহাদ্দিস মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল আমির ইয়ামানি “সুবুলুস সালাম” শরহু বুলুগিল মারাম” গ্রন্থে (১/৩৫১-৩৫২) এই হাদিসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে পুরুষ ও মহিলার সেজদার পার্থক্য করেছেন।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স.) ইরশাদ করেছন-‘মহিলা যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন (ডান) উরু অপর উরুর উপর রাখে। আর যখন সেজদা করবে তখন যেন পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। যা তার সতরের জন্য অধিক উপযোগী। আল্লাহ তাআলা তাকে দেখে বলেন- ওহে আমার ফেরেশতারা! তোমরা সাক্ষী থাক। আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম। (সুনানে বায়হাকি: ২/২২৩, হাদিস নং: ৩৩২৪, হাদিসটি হাসান)
ওয়াইল বিন হুজর (রা.) বলেন, আমি নবীজি (স.)-এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবির: ২৮, হাদিসের মান- হাসান)
ওয়াইল বিন হুজর (রা.) বলেন, আমি নবীজি (স.)-এর দরবারে হাজির হলাম। তখন তিনি আমাকে (অনেক কথার সাথে একথাও) বলেছিলেন যে, হে ওয়াইল বিন হুজর! যখন তুমি নামাজ শুরু করবে তখন কান বরাবর হাত উঠাবে। আর মহিলা হাত উঠাবে বুক বরাবর। (আল মুজামুল কাবির: ২৮, হাদিসের মান- হাসান)
ইবরাহিম নাখয়ি (রহ) বলেন, মহিলা যখন সেজদা করবে তখন যেন সে উভয় উরু মিলিয়ে রাখে এবং পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ১/৩০২, হাদিস নং: ২৭৯৫) ইবরাহিম নাখয়ি (রহ) আরও বলেন, ‘মহিলাদের আদেশ করা হত তারা যেন সেজদা অবস্থায় হাত ও পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখে। পুরুষের মত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফাঁকা না রাখে। যাতে কোমর উঁচু হয়ে না থাকে। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক: ৩/১৩৭, হাদিস নং: ৫০৭১)
হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘মহিলা যখন সেজদা করে তখন সে যেন খুব জড়সড় হয়ে সেজদা করে এবং উভয় উরু পেটের সাথে মিলিয়ে রাখে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক: ৩/১৩৮, হাদিস: ৫০৭২, মুসান্নাফে ইবনে শাইবা: ২/৩০৮, হাদিস: ২৭৯৩, সুনানে কুবরা বায়হাকি: ২/২২২)
ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো- মহিলারা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন, ‘খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১/৩০২, হাদিস: ২৭৯৪)
বিশিষ্ট তাবেয়ি আতা বিন আবি রাবাহকে জিজ্ঞেস করা হলো- ‘নামাজে মহিলা কতটুকু হাত উঠাবে?’ তিনি বললেন-‘বুক বরাবর’। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা: ১/২৭০, হাদিস: ২৪৮৬)
হানাফি মাজহাবে নারীদের নামাজে বসার পছন্দনীয় পদ্ধতি হলো—উভয় পা একপাশে মিলিয়ে রাখবে, পুরুষের মতো এক পা দাঁড় করিয়ে রাখবে না। (কিতাবুল আসার: ১/৬০৯, আরো দ্রষ্টব্য- হেদায়া: ১/১০০-১১০-১১১- ফতোয়ায়ে শামি: ১/৫০৪- ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ১/৭৩)
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, আল্লাহ পাক নারীদেরকে পুরোপুরি পর্দায় থাকার শিক্ষা দিয়েছেন এবং রাসুল (স.)-ও অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হলো- সেজদা অবস্থায় নারীরা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সেজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের অধিক হেফাজত হয়। (যাখিরা, ইমাম কারাফি: ২/১৯৩)
তাকবিরে নারীদের হাত ওঠানো সম্পর্কে ইমাম আহমদ (রহ) বলেন, হাত তুলনামূলক কম ওঠাবে। (আল মুগনি: ২/১৩৯)
হাদিস, আসারে সাহাবা, আসারে তাবেয়িন ও ইমামদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তের আলোকে এ কথা সুস্পষ্ট হলো যে, পুরুষ ও নারীর নামাজের পদ্ধতির অভিন্ন নয় বরং ভিন্ন।
ইসলামে নারীর ইবাদত কিছুটা আলাদা হওয়ার কারণ হলো-তাদের শারীরিক গঠন, সক্ষমতা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয় পুরুষ থেকে ভিন্ন। যেমন—ইহরাম অবস্থায় পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা নিষেধ। কিন্তু মহিলাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় মাথা ঢেকে রাখা ফরজ। ইহরাম খোলার সময় পুরুষ মাথা মুণ্ডায়; কিন্তু মহিলাদের মাথা মুণ্ডানো নিষেধ। পুরুষের ওপর জুমা পড়া ফরজ, নারীদের ওপর নয়। ইমাম ও খতিব শুধু পুরুষই হতে পারে, কোনো নারী হতে পারে না। আজান শুধু পুরুষই দিবে, কোনো নারীকে মুয়াজ্জিন বানানো জায়েজ নেই। পুরুষের সতর হলো নাভি থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আর পরপুরুষের সামনে নারীদের প্রায় পুরো শারীরই ঢেকে রাখা ফরজ ইত্যাদি।
ঠিক তেমনিভাবে নামাজের নিয়মের ক্ষেত্রেও ইসলামি শরিয়ত নারী-পুরুষের মধ্যে বেশ কিছু বিধানগত ভিন্নতা দিয়েছে। যেমন তাকবিরে তাহরিমার জন্য হাত উঠানো, হাত বাঁধা, রুকু, সেজদা, প্রথম ও শেষ বৈঠক ইত্যাদি ক্ষেত্রগুলোতে পুরুষের সঙ্গে নারীর পার্থক্য রয়েছে। মূলত সতরের পরিমাণ যেহেতু নারীদের বেশি তাই যেভাবে নামাজ পড়লে তাদের নিরাপত্তা বেশি রক্ষা হয় সেদিকটি বিবেচনায় নিয়েছে শরিয়ত।
উল্লেখ্য, নবীজির প্রসিদ্ধ হাদিস ‘তোমরা আমাকে যেভাবে নামাজ পড়তে দেখেছ, সেভাবেই নামাজ পড়’ দ্বারা পুরুষ উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহিহ বুঝ দান করুন। ভুল কেয়াস করা থেকে সাবধান হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।