জেনে নিন শবে বরাতে ইবাদত করবেন যে নিয়মে
ধর্ম ও জীবন ডেস্ক।
শবে বরাত একটি মর্যাদাপূর্ণ রাত। শবে বরাত অর্থ সৌভাগ্যের রজনী। আরবি পরিভাষায় একে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ তথা অর্ধ শাবানের রাত বলা হয়।
হিজরি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে শবে বরাত বলা হয়। শিরক ও বিদ্বেষ-পোষণকারী ছাড়া সবারই ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে এ রাতে। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন- يَطَّلِعُ اللهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন; অতঃপর তিনি তার সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন, কেবল শিরককারী ও বিদ্বেষ-পোষণকারী ছাড়া (এই দুই শ্রেণিকে ক্ষমা করেন না)। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকি: ৩/৩৮২, হাদিস ৩৮৩৩)
এই হাদিসটি নির্ভরযোগ্য ও আমলযোগ্য। কোনো বিশেষ সময়ের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফেরাতের ঘোষণা এলে করণীয় হলো- সেই সময়ে গুনাহ থেকে বিরত থেকে নেক আমলের প্রতি যত্নবান হওয়া, যেন আল্লাহর রহমত ও মাগফেরাতের উপযুক্ত হওয়া যায়। মন থেকে হিংসা দূর করে দিতে হবে।
বিশেষত উম্মাহর পূর্বসূরি ব্যক্তিদের সম্পর্কে অন্তর পুরোপুরি পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য, যাতে রহমত ও মাগফেরাতের সাধারণ সময়গুলোতে বঞ্চিত না হতে হয়।’ (লাতাইফুল মাআরিফ পৃ. ১৫৫-১৫৬)
এই রাতে নফল ইবাদতের ব্যাপারে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- বিশুদ্ধ মতানুসারে নফল ইবাদত একাকীভাবে করা। ফরজ নামাজ তো অবশ্যই মসজিদে আদায় করতে হবে। এরপর যতটুকু নফল পড়ার তা নিজ নিজ ঘরে একাকী পড়বে। এসব নফল আমলের জন্য দলে দলে মসজিদে এসে সমবেত হওয়ার কোনো প্রমাণ হাদিস শরিফে নেই। আর সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর রেওয়াজ ছিল না। (দ্র. ইক্তিজাউস সিরাতিল মুসতাকিম: ২/৬৩১-৬৪১; মারাকিল ফালাহ, পৃ-২১৯)
তবে হ্যাঁ, কোনো ঘোষণা বা আহবান ছাড়াই যদি কিছু লোক মসজিদে এসে যায় তাতে সমস্যা নেই। তখন প্রত্যেকে নিজ নিজ আমলে মশগুল থাকবে, একে অন্যের আমলের ব্যাঘাত সৃষ্টির কারণ হবে না।
শবে বরাত উপলক্ষে মাগরিব বা এশার পর থেকে ওয়াজ শুরু করা, এরপর মিলাদ-মাহফিলের অনুষ্ঠান করা সুন্নাহসমর্থিত নয়। কোথাও তো সারারাত খতমে-শবিনা হতে থাকে। উপরন্তু এ সবকিছুই করা হয় মাইকে— এসব ভুল রেওয়াজ। এই রেওয়াজের কারণে ঘরে বা মসজিদে ইবাদতে আগ্রহী মানুষগুলোর ডিস্টার্ব হয়। অসুস্থ ব্যক্তিদের বিশ্রামেও মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে। আল্লাহ আমাদের এসব ভুল আমল পরিহার করার তাওফিক দিন। কিছু অনির্ভরযোগ্য বই-পুস্তকে এই রাতে নামাজের নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন লেখা আছে, যেমন এত রাকাত হতে হবে, প্রতি রাকাতে এই সুরা এতবার পড়তে হবে ইত্যাদি―এগুলো ঠিক নয়। বরং স্বাভাবিকভাবে যেকোনো সুরা দিয়ে দুই রাকাত করে নফল নামাজ পড়বে। (দ্র: আলআছারুল মারফুআ, আবদুল হাই লাখনোভি পৃ: ৮০-৮৫)
এছাড়াও বেশকিছু আপত্তিকর কাজকর্ম দেখা যায় এ রাতকে ঘিরে। যেমন, মসজিদ, ঘর-বাড়ি বা দোকানপাটে আলোকসজ্জা করা, পটকা ফুটানো, আতশবাজি, কবরস্থান ও মাজারে আলোকসজ্জা ও ভিড় করা, নারীরাও দোকানপাট, মাজার ইত্যাদিতে ভিড় করা, তরুণ ও যুবক ছেলেদের সারারাত শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ানো, হৈ-হুল্লোড় করা। শায়েখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ) বলেন, এই রাতের নিকৃষ্ট বেদআতসমূহের মাঝে ঘর-বাড়ি, দোকানপাট আলোকসজ্জা করা, হৈ চৈ ও আতশবাজির উদ্দেশ্যে সমবেত হওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এগুলোর স্বপক্ষে কোনো জাল রেওয়ায়েতও পাওয়া যায় না। সম্ভবত হিন্দুদের ‘দেওয়ালী’ প্রথা থেকে তা গ্রহণ করা হয়েছে। (মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ, পৃ: ৩৫৩-৩৬৩)
আর কিছু কাজ আছে, যা অন্য সময় করা জায়েজ, কিন্তু শবে বরাতে সেগুলোর পেছনে পড়ে শবে বরাতের আমল থেকে বঞ্চিত হওয়া কিছুতেই ঠিক নয়। যেমন খিচুড়ি বা হালুয়া-রুটি রান্না করে খাওয়া বা খাওয়ানো। সাধারণ সময়ে এগুলো করা জায়েজ হলেও শবে বরাতে এগুলোর পেছনে পড়ে মূল কাজ তওবা-ইস্তেগফার, নফল ইবাদত প্রভৃতি থেকে বঞ্চিত থাকা একেবারেই ঠিক নয়। বস্তুত এগুলো শয়তানের এক প্রকার ধোঁকা, যেন মানুষ মূল কাজ ভুলে এগুলোতে ব্যস্ত থাকে। প্রসিদ্ধ তাবেয়ি সুফিয়ান সাওরি (রহ) বলেন- ‘ইবলিসের নিকট নাফরমানির চেয়েও বিদআত বেশি প্রিয়। কারণ নাফরমানি থেকে তাওবা করার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু বিদআত থেকে তাওবা করার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।’ (শাতিবি, আলইতিসাম: ১/১১; ইমাম সুয়ুতি, আলআমরু বিল ইত্তিবা পৃ-১৯)
অনেকে মনে করেন শবে বরাতের ফজিলত শবে কদরের মতো। এ ধারণা সঠিক নয়। কোরআন-হাদিসে শবে কদরের যত ফজিলত এসেছে শবে বরাত সম্পর্কে আসেনি। বিশেষত শবে কদরে কোরআন মাজিদ নাজিল হওয়ার মতো বরকতময় ঘটনা ঘটেছে। এ ফজিলত অন্য কোনো রাতের নেই।
আবার অনেকে মনে করেন কোরআন মাজিদের সূরা দুখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলে শবে বরাত উদ্দেশ্য। এ ধারণাও সঠিক নয়। ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ বলে শবে কদর উদ্দেশ্য, সুরা কদরে বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তাই ভিন্ন কোনো ধারণা পোষণ করার সুযোগ নেই। (দ্রষ্টব্য: লাতায়েফুল মাআরেফ: পৃ. ২৬৮; মাকালাতুল কাওছারি, পৃ: ৪৯-৫০)
শবে বরাতের বিশেষ কোনো রোজা নেই। তবে কেউ চাইলে আইয়ামে বিজের রোজা রাখতে পারেন। প্রত্যেক মাসেই আইয়ামে বিজের রোজা রাখা ফজিলতপূর্ণ আমল। প্রতি চান্দ্রমাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে ‘আইয়ামে বিজ’ বলা হয়। শাবান মাসেও এই রোজাগুলো রাখা সুন্নত। আবু জর ও কাতাদা ইবনে মিলহান (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (স.) আইয়ামে বিজ তথা শুক্লপক্ষের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে প্রতি মাসে এই তিন দিন রোজা রাখতে বলেছিলেন।’ (তিরমিজি: ৭৬১; নাসায়ি: ৪/২২৩-২২৪; ইবনে মাজাহ: ১৭০৭-১৭০৮; আবু দাউদ: ২৪৪৯) কিন্তু বিশেষভাবে শবে বরাতে রোজা রাখা সুন্নত ও মোস্তাহাব মনে করা যাবে না।
মনে রাখতে হবে, কোনো নির্দিষ্ট তারিখে নয়, বরং পুরো শাবান মাসই নফল রোজার উপযুক্ত মাস। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আমি নবী কারিম (স.)-কে শাবান মাসের মতো এত অধিক (নফল) রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। এ মাসের অল্প ক’দিন ছাড়া বলতে গেলে সারা মাসই তিনি রোজা রাখতেন। (তিরমিজি: ৭৩৭)।