২১শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৬ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

টিকার স্টক ফুরিয়ে যাচ্ছে

নিউজ ডেস্ক

পুরোপুরি সুরক্ষা না দিলেও করোনা নিয়ন্ত্রণে অন্যতম উপায় হচ্ছে এই ভাইরাসের প্রতিরোধী টিকা। দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয়ভাবে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয় এবং গত ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে টিকার দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ। কিন্তু এরইমধ্যে দেশে টিকা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। টিকা চেয়ে ভারতের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউটকে চিঠি দেওয়া হলেও এ পর্যন্ত সেই চিঠির কোনও জবাব আসেনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই যদি টিকার বিকল্প সোর্স তৈরি না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে বিপদ নিশ্চিত। একটি মাত্র সোর্সের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ সংকটে পড়তে যাচ্ছে।

দেশে রবিবার (১৮ এপ্রিল) পর্যন্ত টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৭ লাখ ১৪ হাজার ৯০ জন। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৯ জন। অর্থাৎ দুই ডোজ মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৭০ লাখ ৮০ হাজার ৬৯৯ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে।

এদিন বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সারা দেশে টিকার জন্য মোট নিবন্ধন করেছেন ৭১ লাখ ১৯ হাজার ১ জন।

কত টিকা এসেছে

অক্সফোর্ডের তিন কোটি ডোজ টিকা আনতে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে গত বছরের পাঁচ নভেম্বর যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে তিন কোটি ডোজ টিকা রফতানি করবে এবং সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টিকা পাচ্ছে না।

জানা গেছে,এ পর্যন্ত ভারত থেকে টিকা এসেছে মোট এক কেটি দুই লাখ ডোজ। এরমধ্যে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে গত ২১ জানুয়ারি প্রথমে আসে ২০ লাখ ডোজ। সরকারের অর্থে কেনা টিকার প্রথম চালানে ২৫ জানুয়ারি আসে ৫০ লাখ ডোজ, ফেব্রুয়ারি মাসের ২৩ তারিখ আসে আরও ২০ লাখ ডোজ এবং সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ আসে ১২ লাখ ডোজ। অর্থাৎ, ভারত থেকে কেনা ও উপহার মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট টিকা এসেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ।

দেশে গত সাত ফেব্রুয়ারি থেকে গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। গত ৮ এপ্রিল থেকে শুরু হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ। গত ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য চুক্তির ৩০ লাখ এবং মার্চ মাসের ৫০ লাখ— অর্থাৎ চুক্তির ৮০ লাখ টিকা এখনও দেশে আসেনি। এপ্রিল মাসে টিকা আসার সম্ভাবনা এখনও পর্যন্ত নেই।

স্বাস্থ অধিদফতরের সূত্র জানায়, দেশে এখন মজুত টিকা রয়েছে ৪৯ লাখের মতো। আর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া বাকি রয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪৮১ ডোজ। প্রথম এবং দ্বিতীয় ডোজ টিকা যদি বর্তমান হারে চলতে থাকে, তাহলে মজুত টিকা ফুরিয়ে যাবে আগামী ১৫ থেকে একমাসের মধ্যে।

শঙ্কায় স্বাস্থ্য বিভাগ

সম্প্রতি ভারত সরকার অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রেজেনেকার টিকা রফতানি সাময়িকভাবে স্থগিত করায় টিকা পাওয়া নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

টিকা পাওয়া যাবে কিনা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক গত ২৯ মার্চ বলেছেন, এই মাসে টিকার যে চালান আসার কথা ছিল, সেই টিকা আমরা পাইনি। সেটা যথাযথ পাওয়ার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আর যদি টিকা না পাই, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে চিন্তা করতে হবে।’

এরপর গত ৬ এপ্রিল ‘ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী করোনা ভ্যাকসিনের ডোজ গত মাসে আমরা পাইনি’ মন্তব্য করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফের বলেন, ‘ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। টিকার ব্যাপারে তাগাদা দেওয়া হচ্ছে।’

এদিকে, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকাদান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া যাবে কিনা, সে নিয়ে চিন্তিত তারা। এর কারণ হিসেবে হাতে যথেষ্ঠ পরিমাণ টিকা না থাকার কথাও জানান তারা।

অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, টিকা চেয়ে সেরাম ইনস্টিটিউটকে চিঠি দেওয়া হলেও তার জবাব এখনও আসেনি। এতে করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

স্পুটনিক-ভি সমাধান হতে পারে

মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক-ভি টিকা বিভিন্ন পরীক্ষায় সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত। দেশে এই টিকা আনার জন্য একটি কনসোর্টিয়াম কাজ করছে। তারা ইতোমধ্যেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন জমা দিয়েছে। স্পুটনিক-ভি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি দেশে ব্যবহার হচ্ছে। ভারতেও ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনও এর অনুমোদন দেয়নি।

টিকার বিকল্প সমাধান খোঁজার জন্য অনুরোধ করেছেন জাতীয় কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি একটা সমাধান হতে পারে।’

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। আর সরকার কেবলমাত্র একটি সোর্স থেকে টিকা আনছে। একটি মাত্র সোর্সের ওপর নির্ভরশীলতা আমাদের জন্য দুর্বলতা।’

সেক্ষেত্রে স্পুটনিক আমদানি করা যেতে পারে, তাহলে অন্তত ‍কিছুটা হলেও ভ্যাকসিনের এই সংকট কেটে যেতে সাহায্য করবে বলে জানান তিনি।

শঙ্কা থাকলেও চলছে চেষ্টাও

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘প্রতিদিন যদি এক লাখ করে টিকা দেওয়া হয়, তাহলে বাকি টিকা দিয়ে একমাস চলা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘তবে মে মাসে কোভ্যাক্স থেকে এক কোটি ৯ লাখ ডোজ পাওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। যদি এটা এ সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়, তাহলে সংকট এড়ানো যাবে।’

অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘এছাড়াও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ভ্যাকসিন নিয়ে চুক্তি করার চেষ্টা হচ্ছে। সেটাও যদি আনা যায় তাহলেও সংকট থাকবে না।’

টিকা কোথাও না কোথাও থেকে আসবে। না আসার কোনও কারণ নেই জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, তবে কোভ্যাক্স থেকে অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা আসবে। একইসঙ্গে কোভ্যাক্স থেকে জুনের শেষের দিকে ফাইজারের টিকা আসবে, যদিও সেটা পরিমাণে অনেক কম। হয়তো এক লাখ। এক লাখ দিয়ে ৫০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়া যাবে।

তিনি বলেন, প্রথম ডোজ এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লাখ মানুষকে দেওয়া হয়েছে। তাহলে সেটা আরও এই পরিমাণ মানুষকে দিতে হবে। সেখানে আছে ৪২ লাখের মতো। আরও ১৬ লাখ দরকার। আশা করি, সেটা হয়তো চলে আসবে। কোভ্যাক্স থেকে আসতে পারে, ভারত থেকেও আসতে পারে।

ভারত থেকে কবে আসতে পারে জানতে চাইলে অধিদফতরের এই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তাদের নিজেদের টিকাই নাই। তবে বিভিন্ন জায়গা থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে।

সেটা না হলে মে মাসের মাঝামাঝি গিয়ে কিছুটা স্লো হতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, এছাড়া ঝামেলা হওয়ার কথা না।

ইতোমধ্যে যারা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টিকা কিনে রেখেছে, তারাও টিকা ছেড়ে দেবে। সেটা চলে যাবে কোভ্যাক্সে। আমরাতো কোভ্যাক্স থেকে ৬ কোটি ৮০ লাখ টিকা পাবোই মন্তব্য করে এই কর্মকর্তা বলেন, যদিও একটু হতে পারে ১৫ মে থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এই সময়ে একটা সমস্যা হতে পারে, যেহেতু একটা ক্রাইসিস পিরিয়ড চলছে। সবাই চিন্তিত, তবে গ্লোবাল ইকুয়েশনে মনে হচ্ছে— তেমন ক্রাইসিসে পরার কথা না, বলেন তিনি।

টিকা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘একটু শঙ্কা রয়েছে। তবে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি এর সমাধান করার। যদি সেরামের কাছ থেকে সময় মতো টিকা দ্রুত নাও পাওয়া যায়, তাহলে অন্য উৎস থেকে আনার চেষ্টা করবো।’

আরো দেখুন
error: Content is protected !!