মাছ চাষে সাফল্যের চূড়ায় বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক
তিন দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে প্রায় ২৫ গুণ। স্বাদুপানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। দেশে উৎপাদিত মাছের ৭৫ শতাংশ এখন বাজারজাত করছেন মৎস্য চাষিরা। এছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফিরিয়ে আনা হয়েছে ২৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরে মাছ উৎপাদনে রের্কড সৃষ্টি করছে বাংলাদেশ। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে মাছের উৎপাদন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার টন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার টন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪২ লাখ ৭৭ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৩ লাখ ৮১ হাজার টন।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা মাছ নিয়ে তাদের ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২০’ শিরোনামে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাদু পানির উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ আহরণে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়।
মৎস্য খাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির ব্যাপক সম্ভাবন তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তিনি বলেছেন, ‘মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ এখন মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া অনেক প্রজাতির মাছ এখন চাষ করা হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া মাছ চাষ হচ্ছে সরকারি-বেসরকারিভাবেও। মাছ চাষে আরো গবেষণা হবে। এ ছাড়া মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় সরকার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ইলিশ ধরা বন্ধ থাকার সময় জেলেদের নানা ধরনের সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।’ সরকারের নানামুখী কর্মকা- ও বেকারত্ব নিরসনে মৎস্য খাত বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘যে মাছ যে পরিবেশে থাকে, প্রজনন করার জন্য সেটি তৈরি করতে হয়। প্রজাতিটি কোন পরিস্থিতিতে ডিম দেয় সেটা বের করতে হয়। পেটে ডিম কোন মাসে কত শতাংশ আসছে সেটা স্টাডি করতে হয়। মে মাস ডিম দেওয়ার উপযুক্ত সময়, সে সময়টা টার্গেট করে আমরা পরিবেশ তৈরি করি। তবে সব মাছ একই সময়ে ডিম দেয় না। এক মাছের ডোজ একেক রকম। এটি অপটিমাইজ করতে সময় লাগে। এমনও আছে যে আমরা একটি মাছের জন্য ১৫ বছর ধরে চেষ্টা করছি, কিন্তু হচ্ছে না। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে আরো ৪-৫টি প্রজাতি আসতে পারে। সেগুলো অনেকটাই প্রস্তুত হয়ে আছে।’
বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফেরাতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বিএফআরআই। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির অনেক মাছ আবার ফেরাতে কয়েকটি ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ পদ্ধতি আবিষ্কার করে ২৪ প্রজাতির বিলুপ্তপ্রায় দেশি মাছ ফিরিয়ে এনেছেন গবেষকরা। এছাড়া আরো ১০ প্রজাতির মাছ নিয়ে চলছে গবেষণা। এর মধ্যে পাঁচটির গবেষণা চূড়ান্ত সফলতার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে জানিয়েছে বিএফআরআই।
ময়মনসিংহে অবস্থিত বিএফআরআইয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের একটি বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে দেশি প্রজাতির ছোট মাছ। দেশে মিঠা পানির মাছের মোট প্রজাতি ২৬০টি। এর মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালের তথ্য মতে, এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজাতি ৬৪টি। মাঠ পর্যায়ে প্রযুক্তি সম্প্রসারিত হওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে।
বিএফআরআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ধারাবাহিকভাবে গবেষণার মাধ্যমে পাবদা, টেংরা, শিং, মাগুর, গুলশা, গুজি আইর, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালি, জাত পুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, কুঁচিয়া, বাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালবাউশ, দেশি কৈ, গজার, গনিয়া এবং আঙ্গুস বা আগুনমুখা এই ২৪টি প্রজাতির দেশীয় মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়া ইনস্টিটিউট বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় মাছ ঢেলা, শাল বাইম, রানী, কাজলি, পিয়ালি, বাতাসি, কাকিলা, ভোল, বাইক্যা ও মিঠা পানির পোয়া এই ১০টি মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ নিয়ে গবেষণা করছে। এর মধ্যে ৪-৫টি মাছের ক্ষেত্রে আগামী জুন মাসের মধ্যে সফলতা আসবে বলে জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘প্রাচীনকাল থেকে দেশি প্রজাতির মাছ আমাদের সহজলভ্য পুষ্টির অন্যতম উৎস্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এসব মাছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ রয়েছে। এসব উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে এবং রক্তশূন্যতা, অন্ধত্ব প্রভৃতি রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলাশয় সংকোচন, অতি আহরণসহ নানা কারণে মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাশয়ে ছোট মাছের প্রাপ্যতা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।’ বিলুপ্তপ্রায় ও দেশীয় মাছের ওপর গবেষণা করে এরই মধ্যে ২৪ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে জানিয়ে বিএফআরআই মহাপরিচালক বলেন, ‘এসব প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছের প্রাপ্যতা সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মাছের মূল্য সাধারণ ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে এসেছে।’ ডিজি ইয়াহিয়া মাহমুদ আরো বলেন, ‘এর আগে শুধু ময়মনসিংহের স্বাদুপানির মাছ গবেষণা কেন্দ্র থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা পরিচালনা করা হতো। এখন ময়মনসিংহের কেন্দ্র ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর এবং যশোর উপকেন্দ্রেও বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে।’ গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিএফআরআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, আইইউসিএনের তথ্য অনুযায়ী টেংরা বর্তমানে একটি বিপন্ন প্রজাতির মাছ। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজনন, পোনা প্রতিপালন এবং চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়। উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মৎস্য অধিদফতরে এরই মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
এছাড়া বিপন্নের হাত থেকে রক্ষায় বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সৈয়দপুর স্বাদুপানি উপকেন্দ্র রংপুরের চিকলি নদী ও দিনাজপুরের আত্রাই নদী থেকে বরালি মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রতিপালন করে। ২০২০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বরালি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সফলতা আসে। ফলে এর পোনা সহজলভ্য হয়েছে এবং এরই মধ্যে উত্তরবঙ্গে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে।
এদিকে বালাচাটা মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ইনস্টিটিউট থেকে ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়।
খলিশা মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবং চাষের জন্য পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সাল থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট গবেষণা পরিচালনা করে। ২০১৮ সালে মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য আসে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে রেকর্ড করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশে দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মৎস্য খাত। জাতীয় অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান জিডিপিতে ৩.৫০ শতাংশ এবং কৃষি খাতের অবদান ২৫.৭১ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করে ৪ হাজার ৩০৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা।
মাঝে বেশ কয়েক বছর দেশের ইলিশ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছ রক্ষা ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে মা ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপের কারণে ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে সম্প্রতি মাছের বাজারেও দেখা মেলে বেশ বড় সাইজের রুপালি ইলিশ। স্বাদ ও সাধ্য মিলিয়ে কেনা যায় পছন্দের ইলিশ। শুধু ইলিশ নয়, অন্যান্য মাছের উৎপাদনও বেড়েছে। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
মৎস্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৮ হাজার ৯৩৫ টন মাছ ও মৎস্যজাত দ্রব্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছে ৪ হাজার ৩০৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এ রপ্তানি আয়ের বড় অংশই এসেছে চিংড়ি থেকে। দেশের রপ্তানি আয়ের ৪ শতাংশের বেশি আসে মৎস্য খাত থেকে। পাঙ্গাশ, তেলাপিয়াসহ অন্য মাছ বিদেশে রপ্তানি শুরু হলে আয় কয়েক গুণ বাড়বে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দাবি করছেন। (তথ্যসুত্রঃ দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ)