হোগলা পাতার ভাঁজে, সন্ধ্যা রাণীর সংসার চলে
মহানগরনিউজ ডেস্ক।।
হোগলা পাতার ছাউনি দিয়ে গভীর বনে,
চাঁদের আলো, জোছনা ছড়ায় আমার পানে।
শংকা থাকে নিশি জাগা সখি- সখায়,
বিপদটাকে সঙ্গি করে নাকের ডগায়।।
কুমিল্লার বরুড়ার শাকপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের সন্ধ্যা রাণীর বয়স ৬০ ছুঁই ছুঁই। এ বয়সেও হোগলাপাতা শুকিয়ে অনায়াসে পাটি বোনেন তিনি।
হোগলাপাতার এসব পাটিকে স্থানীয় ভাষায় বিছানা বা ধারি বলা হয়। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির অন্যদের দেখে এ কাজ রপ্ত করেন সন্ধ্যা রাণী। এখন তার দেখা দেখি ছেলে, পুত্রবধূসহ ঘরের চার-পাঁচজন মিলে হোগলার পাটি বোনেন।
সন্ধ্যা রাণী বলেন, ‘আমরা এক-একজনে দিনে চার-পাঁচটা পাটি বানাতে পারি। বেশি খাটনি দিলে দিনে পাঁচটাও বানানো যায়। এক-একটি পাটি বিক্রি করি ৭০-৭৫ টাকায়। এই দিয়ে আমার সংসার চলে যায়।’ সন্ধ্যা রানীর মতো এই উপজেলার ১০ গ্রামের প্রায় দুই হাজার পরিবারের সংসার চলে হোগলাপাতার পাটি বুনে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাটি বানানো হয় মধ্য লক্ষ্মীপুর গ্রামে। এই পাটি বিক্রির জন্য লক্ষ্মীপুর বাজারে প্রতি শুক্র ও সোমবার হাটও বসে।
মধ্য লক্ষ্মীপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মাঠে চাষ করা হোগলাপাতা কাটছেন কেউ, কেউ ব্যস্ত সেগুলো পরিষ্কারে। এরপর সেগুলো রোদে শুকাতে বিছিয়ে রাখা হচ্ছে। ওই গ্রামের বেশিরভাগ বাড়ির উঠোনে-আঙিনায় স্তূপ করে রাখা আছে শুকনো হোগলাপাতা ও পাটি।
দিনের সাংসারিক কাজ সেরে দুপুরের দিকে ঘরের উঠোনে বসে পান চিবুতে চিবুতে পাটি বুনতে বসে যান নারীরা। তাতে সাহায্য করতে দেখা যায় বাড়ির পুরুষদের। এর ফাঁকে চলে তাদের নানা গল্প। পাতার ভাঁজে ভাঁজে বুনতে থাকেন ভবিষ্যতের স্বপ্নও।
সোমবার হাটে পাটি বিক্রি করতে আসা নিখিল চন্দ্র সরকার জানান, তার পরিবার শত বছর ধরে পাটি বানায়। এখন শ্রমিকও রেখেছেন এ কাজের জন্য। পাটিপ্রতি মজুরি দিতে হয় ২৫ টাকা।
তাতে লাভ কিছুটা কম হয়। নিজেরা তৈরি করলে বিক্রির পর ৩০ টাকা করে লাভ থাকে। তিনি জানান, প্রতি হাটে ৪০টি পাটি আনেন। প্রতি মাসে পাটি বিক্রি করে তার প্রায় পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়।
দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ বাজার থেকে পাটি কিনতে এসেছিলেন পাইকারি ক্রেতা কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘কুমিল্লার আর কোথাও হোগলাপাতার পাটি তৈরি হয় না। আমরা এগুলো কিনে নিয়ে দোকানে বিক্রি করি। প্রতিটি খুচরা ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করি।’
বাজারে পাটির ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে এই পাটির চাহিদা বাড়ে। আগে মসজিদ-মন্দিরে হোগলাপাতার বিছানা বেশি ব্যবহার হতো।
এখন সেখানে স্থান নিয়েছে কার্পেট ও প্লাস্টিকের মাদুর। মূলত নির্মাণাধীন ভবনের কাজে, কোরবানির মাংস কাটায় বেশি ব্যবহার হয় এই পাটি। এর কিছু শৌখিন ক্রেতাও আছে।
মধ্য লক্ষ্মীপুর বাজার কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মন্তাজ মিয়া বলেন, ‘১৯৬২ সালে এই বাজার শুরু হয়। এর আগে এলাকার হোগলাপাতার পাটি বরুড়া বাজারে বিক্রি হতো।
‘করোনার সময় গাড়ি চলাচল না থাকায় পাটি শিল্পীরা কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। এখন আবার তারা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। তবে সরকারের প্রণোদনা পেলে তারা স্বস্তি পেতেন।’
শাকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই ইউনিয়নের ১০টির বেশি গ্রামে হোগলাপাতার চাষ, পাটি তৈরি ও বিক্রি হয়। দুই হাজারের বেশি পরিবার এই পাটি বিক্রির টাকার ওপর নির্ভরশীল। তাদের সহযোগিতার জন্য উপজেলা পর্যায়ে আবেদন জানিয়েছি।’
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘সমাজসেবা কার্যালয় থেকে এই পাটি শিল্পীদের বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেয়া হয়। তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করব।’