২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

” আমার বন্ধু -ইকবাল হোসেন’র বাবা’র পারিবারিক আত্মজীবনী”

“বাবা”

-:পরিচিতি:-
========

মুন্সী মহর আলী-১ ছেলে ও ৩ মেয়ে, ছেলে-মুন্সী আবদুচ্ছোবান ও স্ত্রী আলেকজান বিবি, ওনাদের ৩ ছেলে ২ মেয়ে। বড় ছেলে সৈয়দ হোসেন – স্ত্রী মুকসেদা খাতুন। সৈয়দ হোসেন ও মুকসেদা খাতুন এর ৩ ছেলে ২ মেয়ে। বড় ছেলে ” মাহ্ফুজুল হোসেন” আমার বাবা। ২০০১ইং ১৩ই জুন – বুধবার পরলোকগমন করেন। (ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন)।

 ” বাবা’র হাতের লিখা উওরসুরিদের নাম’ 

১৯২০ইং সনে মার্চ মাসে বর্তমান ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার সদর থানা নাটাই (দঃ) ইউনিয়নের বড়হরন গ্রামের সম্রান্ত ও ধর্নাঢ্য মুসলিম (ছৈয়দ হোসেন ও মুকসেদা খাতুন এর) পরিবার এ জন্মগ্রহণ করেন।

বাবা’র লিখে যাওয়া আত্মজীবনী ও বিভিন্ন সময়ে আলাপ আলোচনায়- বাবা’র সাদামাটা অথচ বর্নাঢ্য জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। জন্ম থেকে দীর্ঘ পথ পারি দিয়েছেন সংগ্রাম করে এবং ব্যাক্তি জীবন এ বাবা-তার সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, চারিএিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতা দিয়ে সমাজ তথা মানুষের মনে দৃঢ় অবস্থান করে নিয়েছেন যা আজ ও উজ্জ্বল হয়ে আছে।

বাবা’র জীবন এর সুদীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় ব্রাহ্মনবাড়ীয়া একটি বর্নাঢ্য অধ্যায় হয়ে আছে। সেই ১৯৩২ইং সনের এপ্রিল মাসে আমার দাদা ছৈয়দ হোসেন এর কঠিন পীড়ার চিকিৎসার জন্য বাবা কিছু দিন ব্রাহ্মনবাড়ীয়ায় অবস্থান করায় এ অধ্যায়ের শুরু। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় তখনই বাবা আমার দাদা কে হারান। দাদা ছৈয়দ হোসেন ইন্তেকাল করেন। (ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাহি রাজিউন)।

পরের বছর প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার জন্য আবারও বেশ কিছু দিন ব্রাহ্মনবাড়ীয়ায় অবস্থান করেন। এর পরের বছর থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মনবড়ীয়া শহরে এম,ই স্কুল (বর্তমান বি-বাড়ীয়া হাই স্কুল) অন্নদা হাই স্কুল এবং জর্জ স্কুল (বর্তমান নিয়াজ মোহাম্মদ হাই স্কুল) এ বাবার স্কুল জীবন কাটে। ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জর্জ হাইস্কুল হতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ব্রাহ্মনবাড়ীয়া শহরে অবস্থানকালিন সময়ে এই শহরে আইনজীবীদের পরনে কালো কোর্ট ও কালো কাপড়ের গাউন বাবার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং নিভৃত মনে বাসনা জাগে যদি উনি এ পেশায় আসতে পারতেন। এ বাসনা ই পরবর্তী সময়ে বাবাকে আইন পেশায় আসতে অনুপ্রেরণা যোগায়।

মেট্রিকুলেশন পাশ এর পর উচ্চ মাধ্যমিক এ পড়তে বাবা কুমিল্লা আসেন। ১৮৯৯ সালে ‘রায় বাহাদুর’ আনন্দ চন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠা করা রাণী ভিক্টরিয়ার নামে ‘ভিক্টোরিয়া’ কলেজ এ ভর্তি হন এবং অবস্থান করেন চর্থা চৌমুহনীতে শেরেবাংলা ছাএাবাস এ। আনন্দ চন্দ্র রায় পেশায় একজন ঠিকাদার হলে ও শিক্ষা অনুরাগী ছিলেন প্রচুর অর্থ ব্যায় করেন ভিক্টোরিয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায়। পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার এজন্য তাকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয়।

ভিক্টোরিয়া কলেজ এ পড়ার সময় ১৯৪১ইং তে বাবা ছাএ সংসদ এর সদস্য নির্বাচিত হন। শেরেবাংলা ছাএাবাস এ থাকাকালীন কিছু সময় বাবার রুমমেট ছিলেন বাবার জুনিয়র এডঃ হায়দার চাচা (ধর্মসাগর পাড়ের সাজ্জাদ ভাই, সোহেল ভাই এর বাবা)।

৯০ এর দশকেও যখন হায়দার চাচা আমাদের বাসায় আসতেন চাচাকে বাবার চেম্বারে বসিয়ে ভিতরে এসে আমি বাবাকে বলতাম বাবা খুব উৎফুল্ল মনে বলতেন হায়দার আসছে? আরও বলতেন ‘হায়দার আমার জুনিয়র ও আমার রুমমেট ছিল শেরেবাংলা ছাএাবাসে’। ভিক্টোরিয়া কলেজ এ পড়ার সময় অল্প কিছুদিনের রুমমেট এর সাথেও আমৃত্যু বাবার কি সুন্দর বন্ধুত্বপুর্ন সম্পর্ক ছিল।

ভিক্টোরিয়া কলেজ হতে ১৯৪২ইং উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জেলার জজ কোর্ট কুমিল্লা হতে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার সরাইল এস্টেটে স্থানান্তরিত হয়। বাবা চলে যান সিলেট এ। সিলেটে গিয়ে মুরারিচাঁদ (এম,সি) কলেজে এ বি,এ ভর্তি হন। সিলেট শহরে ততকালীন বেশির ভাগ বাড়ি ছিল টিন শেড বাংলো টাইপ যা বাবার খুব পছন্দ হয়, ইচ্ছে জাগে যদি আল্লাহ কখনও বাড়ি করার তাওফিক দেন তাহলে এই ধরনের বাংলো টাইপ বাড়ি করবেন। ১৯৪৪ইং তে বাবা এম সি কলেজ হতে বি,এ পাশ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে বাবা চলে যান কলকাতায়। বৃদ্ধ বয়সে অবসর সময়ে প্রায় ই কলকাতার স্মৃতি আওড়াতেন।আমার দাদা বাবা ক্লাস ফোর এ পড়ার সময় মারা যান, দাদীকে রেখে বাবা এত দূর এ কলকাতায় পড়তে যাওয়া বাবার জন্য খুব কষ্টের ছিল। তখন আখাউড়া জংশন হতে সরাসরি ট্রেন যেত কলকাতা। বাবা একবার কলকাতা গেলে ২/৩ মাস পর ফিরতেন। মজার বেপার তখনই এই ট্রেন এর ফিরতি টিকেট কাটা যেত, বাবা যাওয়ার সময়ই ফিরতি টিকেট কেটে নিয়ে যেতেন। কলকাতা গিয়ে যত্ন করে এ টিকেট আগলে রাখতেন আর দিন গুনতেন কবে বাড়ি আসার সময় হবে।

কলকাতায় বাবার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ মাএ শেষ হয়েছে এদিকে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। দেশ ভাগ হয় হয় সময় আর বাবা ভর্তি হলেন দু জায়গায় একই সাথে-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিকস উইথ ব্যাংকিং এন্ড কারেন্সিতে এম,এ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে ল’তে।

ইতিমধ্যে বৃটিশ থেকে স্বাধীন হয়ে দেশ ভাগ হয় ১৯৪৭ এর আগষ্ট মাসে। সৃষ্টি হয় ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র। বাংলাদেশ চলে যায় আরেক পরাধীনতায় পাকিস্তান এর অধীন, নতুন নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। তখন অনেকেই পড়া ছেড়ে কলকাতা থেকে নিজের দেশ পূর্ব পাকিস্তান অংশে চলে আসেন।

বাবা থেকে যান কলকাতা। তখন বাবা কলকাতায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে থাকতেন। ১৯৪৮ সনে বাবার ল’ পরীক্ষা শেষ হয় এবং মাস্টার্স এর দুই বিষয় এ পরীক্ষা শেষ হয়ে আরও দুই বিষয় বাকি। ইতিমধ্যে ভারত বর্ষে রায়ট (হিন্দু মুসলিম দাংগা) শুরু হয়। সমস্ত মুসলিম ছাএরা হল ছেড়ে চলে আসলেও বাবা তখনও কলকাতা ছিলেন। বিকেলে একা একা ভিক্টোরিয়া পার্কের মাঠে বসে থাকতেন, বাদাম খেতেন।

পরবর্তীতে হল বন্ধ ঘোষণা করলে বাবাকে ও চলে আসতে হয়। দাঙ্গা শেষ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পএ মারফত আমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় দুই বিষয় এ পরীক্ষার সময়সূচি জানায়। এ পরিস্থিতিতে এখান থেকে বেশির ভাগ ছাএ না গেলেও বাবা কলকাতায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসেন এবং একই সাথে এম,এ এবং ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। কলকাতা হাইকোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী বাবু অজিত কুমার দও (কুমিল্লার খ্যাতনামা আইনজীবী ও পাকিস্তান সরকারের তৎকালীন আইন মন্ত্রী বাবু কামিনী কুমার দওের পুএ) এর সংগে এডভোকেটশীপ পরীক্ষার জন্য আর্টিকেল ক্লার্ক হন। তখন কলকাতার বিশিষ্ট দেশী-বিদেশী আইনজীবীদের অনেকেরই সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ হয়।

বাবা যখন কলকাতা হাই কোর্টের প্রখ্যাত আইনজীবী ‘বাবু অজিত কুমার দও’ এর সঙ্গে এডভোকেট পরীক্ষার জন্য আর্টিকেল ক্লার্ক হন সেই সময় আমদের নিজ গ্রাম ‘বড় হরন’ এ একটি জটিল মামলার সূচনা হয়। আমাদের গ্রামের প্রতিবেশী আবদুল গফুর সাহেব খুন হন। সে মামলায় শ্রী শ্রী আবদুস সোবহান মুন্সী (বাবার দাদা) ও আবদুল হামিদ ওরফে কালা মিয়া সাহেব (বাবার চাচা) কে ষড়যন্ত্র মুলক ভাবে আসামী করা হয়। ব্রাহ্মনবাড়ীয়া শহরে দায়রা জজ আদালতে মামলাটির বিচার কার্য অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় মামলাটির তদবির করতে গিয়ে প্রয়াত আইনজীবী বাবু কামিনী কুমার দও, রায় বাহাদুর, ভুধর দাস, খান বাহাদুর আবদুল গনি, আবদুল আলীম (আমার বন্ধু লামিনা ইমাম এর দাদা), শ্রী রমনী মোহন দাস, সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ প্রমুখ আইনজীবিদের সাথে বাবার পরিচয় ঘটে। পরে অবশ্য আবদুস সোবহান মুন্সী ও আবদুল হামিদ ওরফে কালা মিয়া সাহেব এই মামলা হতে অব্যাহতি পান।

ইতিমধ্যে দেশ বিভাগের ফলে ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হয়। ১৯৪৮ সালে বাবা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বি,এল ডিগ্রি নিলে ও পারিবারিক কারনে নব সৃষ্ট ঢাকা হাইকোর্ট এ যোগদান করতে না পারায় ব্রাহ্মনবাড়ীয়া বার এর প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী বাবু গোপী মোহন রায় এর সঙ্গে নতুন করে আর্টিকেল শীপ নেন। পরের বছর কুমিল্লার আইনজীবী আবদুল আলিম সাহেবের সাথে আর্টিকেলশীপ নেন এবং ও-ই সময়ের আগষ্ট মাসে আইনজীবী হিসেবে সনদ প্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন এবং আমৃত্যু সদস্য ছিলেন। ইতিমধ্যে ১৯৪৯ ইং এর শুরুতে কুমিল্লা জেলার প্রখ্যাত আইনজীবী সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ এর দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা রওশন আরা বেগম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পূর্বে বাবা মা’কে দেখেননি। বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বিয়ের আগে এক লোক ব্রাহ্মবাড়িয়ায় বাবার সাথে দেখা করে কনে (আমার মা) সম্পর্কে বর্ননা দেন যে কনের গায়ের রং কালো, কনে কে না দেখে বিবাহ করা ঠিক হবে না।

এখানে উল্লেখ্য বাবা’র গায়ের রং ছিল খুব ফর্সা। বাবা ঐ লোককে বললেন কনে কালো হউক আর যাই হউক বাবা দেখবেন না এবং এখানেই বিয়ে করবেন। দৃঢ় মনবল এর অধিকারী বাবা ১০ই জানুয়ারি ১৯৪৯ ইং এর সকাল এ বড়হরন গ্রাম হতে ১০/১৫ জন আত্বীয় মুরব্বি সহ ব্রাহ্মনবাড়িয়া আসেন, সেখান হতে ট্রেন যোগে বর বেশে কুমিল্লা আসেন বিবাহ করার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লা উওর চর্থা তেলিয়াপুকুর পার সৈয়দ আবদুল ওয়াহেদ (আমার নানা) এর বাসায় উনার দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা রওশন আরা বেগম কে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের ট্রেন যোগেই আবার ব্রাহ্মবাড়িয়া রওনা হন।

তখনও ব্রাহ্মনবাড়িয়া হতে আমাদের গ্রামের বাড়ি বড়হরন যাতায়াত করতে হত পায়ে হেটে দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন মাইল। বর্ষায় নৌকা চলতো। শীতকাল হওয়ায় পায়ে হাটা ছাড়া কোন উপায় নেই। বাবা তা’র নতুন বউ এর জন্য ব্রাহ্মনবাড়িয়া রেল স্টেশন এ পালকি ঠিক করে রেখে আসেন। ব্রাহ্মনবাড়িয়া রেল স্টেশনে নেমে মা’ কে পালকিতে নিয়ে সাথে বর যাত্রীরা হেটে বড়হড়ন গ্রাম এ রওনা হন এবং সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যান।

মা’র কাছ থেকে পরবর্তীতে পালকিতে চড়ার অভিজ্ঞতা শুনেছি অনেকবার। পালকি অনেক ছোট থাকে উচ্চতায়ও কম, বসেই থাকতে হয়, খুব বেশি নড়াচড়া করার জায়গা নেই । পালকিবাহক ছিল ৬ জন। দুদিকে ৩ জন করে। পর্দা করার জন্য পুরু পালকি কাপড় দিয়ে মোড়ান ছিল যাতে বাহির হতে দেখা না যায় ফলে ভিতরে অনেক গরম ছিল। পালকি কাঁধে নিয়ে হাঁটার ফলে দোলে এটা প্রথম দিকে একটা ভয়ানক ব্যপার হলেও পরবর্তীতে নাকি খুব মজার বেপার -মা’ খুব উপভোগ করেছিলেন। পালকি বাহকরা পতিমধ্যে কিছু সময় বিশ্রাম নিয়েছেন, মা পানি খাবেন কিনা, নেমে একটু হাটাহাটি করবেন কিনা জিজ্ঞেস করেছেন। সে স্মৃতি মা’র কাছে অম্লান ছিল। এভাবেই বাবা মা’র বিবাহিত জীবন শুরু।বাবা’ তার সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা,চারিএিক দৃঢ়তা ও স্পষ্টবাদিতার কারনে যে বিশাল এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন পাশাপাশি খুব রসিক মনের ও মানুষ ছিলেন। নিয়মানুবর্তিতার প্রতি খুব কঠিন ছিলেন। নিয়ম এর বাহিরে কোন কিছু দেখলে খুব রেগে যেতেন। নায্য কথাটা বলতে কাউকে ছাড়তেন না। যার কারনে সবাই খুব ভয় পেত কিন্তু ভিতর গত ভাবে খুব নরম মনের ছিলেন। মানুষের সাথে খুব আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। বড়দের শ্রদ্ধা করা আর ছোটদের আদর স্নেহ করতে ভুলতেন না।

আবদুল আউয়াল (আমার বন্ধু আহাদ/লাবলুর বাবা) চাচা’র একটা কথা খুব মনে পড়ছে। চাচা” ও বিশাল ব্যক্তিত্বের মানুষ ছিলেন এবং আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়। খুব মিষ্টিভাষি। কুমিল্লা পৌরসভার এবং কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি তখন ঢাকায় থাকি, আসছি কুমিল্লা টাউন হল (নগর মিলনায়তন) এর কার্যকরী পরিষদ এর নির্বাচন। আমার সেঝ ভাই মোস্তাক ভাই ও নির্বাচন করে। বিকেল বেলা ভোট দিয়ে বের হয়ে মিলনায়তনের সামনে আউয়াল চাচা,আমি,মোস্তাক ভাই ও আনোয়ার (মুন্সেফবাড়ির ইউসুফ চাচার সেঝ ছেলে,ইউসুফ চাচা ও আউয়াল চাচা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু) ভাই আমরা দাড়িয়ে কথা বলছি। আউয়াল চাচা অনেক কিছু বলতেছেন আমরা শুনছি। বাবা’র কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বললেন মাহফুজ ভাইসাব যদি কখনও ডাক দিতেন আগে এক গ্লাস পানি খাইতাম কোন ভুল করছি কি না এই ভেবে।

আমি বললাম চাচা আপনিত দু যায়গায় চেয়ারম্যান ছিলেন, উনি বললেন রাখ তোর চেয়ারম্যান- মাহফুজ ভাইসাব ডাক দিসে মানি কোন ভুল হইছে। এই ভেবে ভয় হত। পাশাপাশি বললেন বাবা উনাকে খুব আদর ও করতেন বাসায় আসলেই মিষ্টি খাওয়াতেন আপ্যায়ন করতেন। এ দিনের ঠিক এ সপ্তাহের দিন আউয়াল চাচা মৃত্যু বরন করেন। আল্লাহ আউয়াল চাচাকে বেহেস্ত নসিব করুক।

আউয়াল চাচার কথাগুলো এখনও আমার কানে ভাসে, চাচার চেহারাটা মনে পরে। এইভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রত্যেকের সাথে বাবার সুসম্পর্ক ছিল। মা’কে বিয়ে করে গ্রামের বাড়ি বড়হরন নিয়ে গেলেন পাশাপাশি পেশাগত ও নতুন জীবন। দাদাকে ছোট বেলায় হারিয়ে একাকী পড়ালেখা করে এতটুকু আসা। এখন শুরু হল নতুন সংগ্রাম।

আইন পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা। আমার নানা ও আইনজীবী ছিলেন কিন্তু বাবা কখনো নানার সাথে এডভোকেসি করেননি বরং কখনো কখনো কোন কোন বড় মামলায় দুজন দুপক্ষের হয়ে লড়েছেন। পেশাগত এ লড়াই কখনো তাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোন প্রভাব পরেনি।আমাদের কাছে এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমার নানা ও কুমিল্লা বার এর খুব নামকরা আইনজীবী ছিলেন। কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতির প্রথম মুসলিম সভাপতি। নানা’র পূর্বে কোন মুসলিম সভাপতি নির্বাচিত হননি এবং এক নাগারে প্রায় ৬/৭ বার নির্বাচিত হন। বাবা ১৯৫১ইং এর মার্চ মাসে কুমিল্লা নওয়াব কোর্ট অব ওয়ার্ডস এবং পশ্চিমগাঁও নওয়াব কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর ল- এজেন্ট নিয়োগ হন।

পরবর্তীতে সাচার দেবোওর কোর্ট অব ওয়ার্ডস এষ্টেট ও ভূকৈলাশ রাজ গ্রুপ কোর্ট অব ওয়ার্ডস এর আইনজীবী হিসেবে ১৯৫৬ ইং সন পর্যন্ত কাজ করেন। পাশাপাশি অষ্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক, রুপালী ব্যাংক সহ বিভিন্ন ব্যাংক এর আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৯ইং সালেই বাবা কুমিল্লা টাউন হল এর সাধারণ সদস্য এবং পরবর্তীতে ১৯৮৩ইং সালে আজীবন সদস্য হন। ১৯৫৬ইং সনে হাইকোর্ট এর সনদ প্রাপ্ত হন।

বিঃদ্রঃ আমাদের বড়হরন গ্রামের বাড়ির ছবি। শতবছরের ও আগে বাবার দাদা ‘শ্রী শ্রী আবদুস সোবহান’ সাহেবের তৈরি। আমার বড় আব্বা আবদুস সোবহান যিনি কলকাতার বিশিষ্ট ব্যবসায়ি ছিলেন এবং কলকাতা হতে ইট শুড়কি এনে এ বাড়ি এবং একটি মসজিদ তৈরি করেন। বাড়ি আজও একই রকম আছে। বাবা বিয়ে করে মা’কে পালকিতে করে এই বড়িতে নিয়ে যান।

চলবে…..

 

আরো দেখুন
error: Content is protected !!