২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

করোনাযোদ্ধা এক চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

সম্পাদকীয় ডেস্ক

‘দুলাভাই আপনার কাজ আমি করতে পারব না, তবে আমার চেয়ারে যে আসবে সে করে দেবে আশা করি। আমার চাকরি জীবনের আজকেই শেষ দিন। আগামীকাল থেকে পিআরএল এ চলে যাব’। আমার আর দরকার নেই কাজের। যেখানে তুষার নেই- সেখান থেকে আমি কোন কাজ পেতে চাই না। উত্তরটা শুনে ও (তুষার) বললো, সরকারি চেয়ার তো আর খালি থাকবে না। আপনার প্রতিষ্ঠানের কাজ হয়ে যাবে। আমি আর কথা বাড়াইনি। ফোন রাখার আগে ও বললো, আপনার স্ত্রী মানে আমার বান্ধবীকে সালাম দেবেন। আপনারা ভালো থাকবেন সবাই। এই ছিল অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ সামছুজ্জামান তুষারের সাথে আমার শেষ কথা। আমার সহধর্মীণী, তুষার ও তুষারের স্ত্রী তিনজনই সহপাঠী। ওরা সবাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ২২তম ব্যাচের। সেই সুবাদে তুষার আমাকে দুলাভাই বলে ডাকত। আমি ছিলাম ১৯তম ব্যাচে। রাজশাহী মেডিকেলের প্রথম বর্ষ থেকে শেষ বর্ষ পর্যন্ত সবগুলো প্রফেশনাল পরীক্ষায় তুষার প্রথম হতো।

এই তুষারের মৃত্যুর সংবাদ পেলাম গত শনিবার (২৪-০৪-২০২১ইং) সকালে। গত ৮ এপ্রিল ছিল অধ্যাপক ডা. সামছুজ্জামান তুষারের সরকারি চাকরিতে শেষ কর্মদিবস। আর সেদিনই এ করোনাযোদ্ধার দেহে ভাইরাসটির সংক্রমণ শনাক্ত হয়। দুদিন বাসায় থাকার পর গত ১০ এপ্রিল তাকে ভর্তি করা হয় শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে। শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওই দিনই নেয়া হয় আইসিইউতে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় । চলে গেল আমাদের চিকিৎসা জগতের আরেক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক এসব নিয়েই ছিল ওর জগৎ। তুষার ছিল মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। চাকরি জীবনের শেষ কর্মস্থল ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টার। এই সেন্টারের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছিলেন অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের প্রতিষ্ঠার শুরু থেকে দায়িত্ব পালন করছিলেন অধ্যাপক ডা. একেএম শামছুজ্জামান। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠান। দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শুরু থেকেই সম্মুখসারির একজন নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা ছিলেন ডা. তুষার। করোনা করুণা করলো না তুষারকে। এককভাবে দেশে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ল্যাবরেটরিতে ৭ লাখেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে তার নেতৃত্বে।

আমি তখন নওগাঁর সিভিল সার্জন। তুষার সে সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক। ২০১৫ সালের ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনা। নওগাঁয় নেয়ামতপুর, মান্দা এই দুই উপজেলায় নিপা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। আক্রান্ত হয় বহু লোক। তিনজন মারাও যায়। তুষার ফোনে বলল, বুলবুল ভাই (আমার ডাক নাম) আপনি তো আমার দুলাভাই। আপনার এলাকায় যাব। দুদিন থাকব। নিপা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে জনসচেতনামূলক সভা করব খেজুর গাছিদের নিয়ে। জেলার ১১টি উপজেলার দেড় হাজার খেজুরগাছি ও মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবীদের নিয়ে এক বিশাল সমাবেশ হয়েছিল নওগাঁ জেলা স্কুলের মাঠে। সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে দেওয়া হয়েছিল এক হাজার করে টাকা। খাওয়ানো হয়েছিল নওগাঁ অঞ্চলের বিশেষভাবে রান্না করা খিচুড়ি।

ওই সমাবেশের প্রধান অতিথি ছিলেন সেই সময়ের জাতীয় সংসদের হুইপ সহিদুজ্জামান সরকার (বর্তমানে সাংসদ, করোনা আক্রান্ত হয়ে তিনি এখন সুস্থ)। মঞ্চে উপস্থিত থাকায় তিনিও পেয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজার টাকা। সভা চলাকালীন সাংসদ আমাকে কানে কানে বলছিলেন নওগাঁ’র খেজুর গাছের মালিক ও চাষিদের এত টাকা দিচ্ছেন এই পরিচালক! ভদ্রলোক খুবই জনদরদী। অতি করিৎকর্মা একজন সৎ অফিসার। সাংসদ সহিদুজ্জামান সরকার ওই দিন তার বক্তব্যে তুষারের দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলেন।

ডা. তুষারের কবিতা বলা ও ছড়া লেখার অভ্যাস ছিল। ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখত। বিস্ময়ের বিষয় কোনো সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে বক্তা হয়ে মঞ্চে বসেই প্রাসঙ্গিক প্রতিবাদ্য বিষয় নিয়ে কবিতা বা ছড়া লিখতেন। ওই সমাবেশেও নিপা ভাইরাস, বাদুড় ও খেজুর গাছিদের নিয়ে ছড়া লিখে তা পড়ে শুনিয়েছেন, যা হয়েছিল উপস্থিত সবার কাছে প্রশংসনীয়।

আজ এ কথা স্মরণে এলে চোখে জল ধরে রাখা যায় না। সবাইকে কাঁদিয়ে তুষার চলে গেল ৫৯ বছর বয়সে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তুষার একটি চিরকুট লিখে গেছে। সেটির পাঠোদ্ধার করলে দাঁড়ায়-

“সন্তানগণ ও আত্মীয়স্বজন।
আমার কবর দিও কোরবানি মাঠে আমার ক্রয়কৃত জায়গায়।
চারিদিকে দেয়াল দিয়ে একটি ঘর বানিয়ে নাম লিখে দিও।
আমার পাশে আমার স্ত্রীর কবর হবে।
শেষ নসিয়ত,
স্বাক্ষর,
১৪-০৪-২০২১”

তুষারের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়ি, মৃত্যুর আগে শেষ ইচ্ছা অনুসারে সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন হয়।

লেখক : সাবেক সিভিল সার্জন, নওগাঁ, উপপরিচালক, সেন্ট্রাল হাসপাতাল লি. ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫।

আরো দেখুন
error: Content is protected !!