জায়গামতো তেল দিন!
লাইফস্টাইল ডেস্ক।।
‘তেল সভ্যতার বাহন’—এটা বলেছিলেন আমার স্কুলশিক্ষক। তার মতে, প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে কিংবা ব্যবসা ও চাকরিবাকরি সবকিছু গতিশীল থাকে তেলের কারণে!
পৃথিবীর সবচেয়ে তৈলাক্ত বাণী নাকি ‘আই লাভ ইউ’! এই শিক্ষক গানও গাইতেন। ‘বাবা ভান্ডারি, তেল ছাড়া চলে না রেলগাড়ি’ গানটা প্রথম তার মুখেই শোনা।
এর অনেক বছর পরে বাংলা ছবির একটা গান শুনেছিলাম এমন—’তেল গেলে ফুরাইয়া/বাত্তি যায় নিভিয়া/কী হবে আর কান্দিয়া’! তেল ফুরিয়ে গেলে কিংবা তেলের আকাল পড়লে তবু মানুষ কাঁদে!
বাড়ির পাশের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকর্মী রঙিলাকে দেখতাম তেলের কারণে পাগল হয়ে যেতে। তেল না থাকলে একরকম মাতম করতেন রঙিলা। গায়ে তেল মাখতেন বডিবিল্ডাররা। শিশুদের গায়ে তেল মেখে গোসল করানোর রেওয়াজ ছিল। যাই হোক, সামান্য সরিষার তেল ছোট্ট শিশিতে দিলে রঙিলা গান গাইতে গাইতে নদীর পাড়ে যেতেন।
এরপর চপচপাচপ শব্দ তুলে সারা গায়ে তেল মেখে ভৈরব নদীতে ঝাঁপ দিতেন। গোসলের সময়েও তার গান থামত না—’ও দরিয়ার পানি/তোর মতলব জানি/ তোরে ছাড়া যৌবনে মোর লাগলো যে আগুন…’
তেলের বাজারে এখন আগুন। ছোটবেলার খাদ্য তালিকার সরিষার তেল এখন ব্যাকফুটে, সয়াবিন এখন হালের ক্রেজ বা ভাইরাল। আগে সরিষার চাষ হতো দেশে, এখনও হয়। আগে তেল কেনার রেওয়াজও ছিল কম। সরিষা তুলে সেটা ঘানিতে ভাঙিয়ে তেল বানিয়ে বাসায় আনাটা ছিল অভ্যাস।
আলু ভর্তা ও ডিমভাজির সাথে সরিষার যে ঝাঁঝ তার কোনো তুলনা থাকতে পারে না! বাঙালির ঝাঁঝের সাথে সরিষার তেলের ঝাঁঝ ছিল মিলনাত্মক। ঘানিতে বসা যেত, ঘানির তালে তালে ঘোরা যেত। সেই সরিষার চাষ কমল, ঘানি হয়ে গেল স্মৃতি।
বিজ্ঞাপনে এখন ঘানিকে ময়লা আর কম উৎপাদনশীল দেখানো হয়। চাষাবাদের বদলে এলাকার মানুষেরা যেতে থাকল সৌদি আরব, কাতার, ইরাক কিংবা মালয়েশিয়ায়। কমল চাষের জমি। খাদ্য তালিকায় থাকল না সরিষা আগের মতো, সেই জায়গা দখল করে নিল সয়াবিন! এই সয়াবিনের এখন কত গুণ!
সয়াবিনে প্রোটিন থাকে ৪০ ভাগ, কার্বোহাইড্রেড ৩৫ ভাগ আর তেল থাকে শতকরা ২০ ভাগ। সয়াবিনকে প্রচার করা হয় বিকল্প প্রোটিন হিসেবে। প্রাণিজ প্রোটিনের চেয়ে সয়াবিনের প্রোটিনে প্লাজমা কোলেস্টেরলের পরিমাণ ২৩ থেকে ২৫ ভাগ কম থাকে। সয়াবিন শুধু মানুষের খাদ্যই না, সয়াবিন গাছ জনপ্রিয় পশুখাদ্যও! গ্লিসারিন, রং, মুদ্রণের কালি কিংবা বিভিন্ন ধরনের সাবানের বাণিজ্যিক উৎপাদনে সয়াবিনের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো!
শুধু সয়াবিন নয়, বাঙালির খাদ্য তালিকায় এখন অলিভ অয়েল, ক্যানোলা ও সূর্যমুখী তেল ছাড়া পামঅয়েলও দেখা যায়। সবকিছুর উপরে উঠে এসেছে সয়াবিন। কারণ কী?
কারণ সয়াবিন সর্ষের মতো উৎপন্ন হয় না। সয়াবিন অনেকটাই আমদানিনির্ভর। দেশে উৎপাদনের চেয়ে বিদেশ থেকে আমদানি অনেকটা চাতুর্যপূর্ণ! আমদানি আর মজুদের সাথে সিন্ডিকেটবাজি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সিন্ডিকেট করলেই লাভ। সিন্ডিকেটে না থাকলে সয়াবিন কেনাতেও ঝামেলা, বেচাতেও! না খেয়ে বাঁচতে পারে না কেউ, তাই সয়াবিন লাগবেই। এই চাহিদার কাছে জিম্মি মানুষ, জিম্মি রাষ্ট্রও!
দুই বছর আগেও যে সয়াবিনের দাম প্রতি লিটার ছিল ৮০ টাকা সেটা ২০২২ সালের রমজানে এসে সরকারকে ঘোষণা দিতে হয় ১৬০ টাকা করে বিক্রি করার। যদিও ব্যবসায়ীরা এই দামে বেচেননি, কেউ কেউ চলে যান মজুদে। এরপর সরকার একবার ১৮০ ও পরে ১৯৮ টাকা দরে সয়াবিনের লিটার বিক্রি করার ঘোষণা দেয়। কিন্তু ২২৫ থেকে ২৪০ টাকার কমে সয়াবিন মেলে না। এক লিটার পাওয়া গেলেও পাঁচ লিটারের বোতল পাওয়া দুষ্কর।