বাংলাদেশের প্রতি এখন ভারতীয়দের অন্য নজর
অনলাইন ডেস্ক
অর্থনীতির সাফল্যে ভর করে বাংলাদেশ যেভাবে একের পর এক মাইলস্টোন অতিক্রম করছে, তা গড়পরতা ভারতীয়দের দৃষ্টিভঙ্গী ক্রমশ বদলে দিচ্ছে। এমন কী, এর প্রভাব পড়ছে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও।
গত দু-চার মাসে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ভারতে বেশ সাড়া ফেলেছে। আগে বাংলাদেশের যেসব কৃতিত্ব ভারতের মিডিয়াতে ঠাঁই পেত না, এমন বেশ কিছু খবর নিয়ে ইদানীং রীতিমতো চর্চা হচ্ছে। আর সেগুলোই প্রতিবেশী দেশের একটা উজ্জ্বল ও ঝকঝকে ছবি তুলে ধরছে।
কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
এক) চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে বাজেট পেশ করার ঠিক আগেই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট কয়েকটি খাতে কীভাবে রফতানি বাড়ানো যায়, সেটা বাংলাদেশের থেকে শেখার আছে। তার পেশ করা ইকোনমিক সার্ভেতে মন্তব্য করা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ রফতানিকারী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০১১-২০১৯ সালের মধ্যে সে দেশের রফতানির কম্পাউন্ড বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৬ শতাংশ হারে, যা ভারতের চেয়ে ০.৯% এবং গোটা দুনিয়ার চেয়ে ০.৪% বেশি।’
দুই) বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা, অধ্যাপক কৌশিক বসু গত ২২ মে সকালে একটি টুইট করেন। যাতে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি খাতের তুলনামূলক পারফরম্যান্স তুলে ধরা হয়েছিল। নিমেষে ভাইরাল হওয়া পোস্টটিতে দেখানো হয়েছিল- চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো অর্থনীতিকে টপকে বিগত অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩.৮ শতাংশ জিডিপি অর্জন করেছে। প্রতি দশ লক্ষ জনসংখ্যায় কোভিড মৃত্যুর সংখ্যাও সে দেশে মাত্র ৭৪। দুটো সারণীতেই ভারত ছিল সবচেয়ে নিচে। যেখানে জিডিপি নেগেটিভ আট শতাংশ। কোভিড মৃত্যুও বাংলাদেশের প্রায় তিনগুণ।
তিন) গত সপ্তাহে কলকাতার বর্তমান পত্রিকায় একটি বিশেষ নিবন্ধ লেখেন হিমাংশু সিংহ। যার শিরোনাম ছিল ‘আত্মনির্ভর ভারতকে পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ’। ৬ মে যেভাবে বাংলাদেশ দশ হাজার ভায়াল জীবনদায়ী রেমডেসিভির ভায়াল ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে এবং তার আগে এক হাজার আধুনিক ভেন্টিলেটর পাঠিয়েছে, সেটিকে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে বর্ণনা করেন তিনি। ভারতে ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল মিডিয়াতেও ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়েছে ওই নিবন্ধের লিংক।
চার) ভারতে তৈরি পোশাক বা গার্মেন্টস শিল্পের অন্যতম প্রধান হাব দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডা, যে শহরকে সরকার ‘সিটি অব অ্যাপারেল’ বলে পরিচয় দেয়। সেই নয়ডাতে অ্যাপারেল এক্সপোর্ট ক্লাস্টারের (এনএইসি) সভাপতি ললিত ঠুকরাল জানিয়েছেন, মহামারিতে তাদের আন্তর্জাতিক ক্রেতারা ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকছেন। বাংলাদেশের (ও কিছুটা শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামে) তারা ইতিমধ্যেই বিশ শতাংশের বেশি ব্যবসা হারিয়েছেন বলে ওই সংগঠনের দাবি।
পাঁচ) বাংলাদেশের মুকুটে সবশেষ পালকটি এনে দিয়েছে পার ক্যাপিটা ইনকাম তথা মাথাপিছু আয়ে নাটকীয় বৃদ্ধি। গতবছরের শেষ দিকেই আইএমএফ পূর্বাভাস করেছিল, মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ ভারতকেও টপকে যেতে চলেছে। আর সেটা এর মধ্যে সত্যিও হয়েছে। গত ১ জুন ব্লুমবার্গ তাদের এই সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম করেছে : ‘দক্ষিণ এশিয়ার এখন নজর দেওয়া দরকার এই অঞ্চলের উজ্জ্বল তারকার দিকে।’ এই তারকাটি, বলাই বাহুল্য, বাংলাদেশ!
ঠিক এক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের ফলাফলে আর একটি জিনিসও প্রমাণ হয়েছে- বাংলাদেশিদের কথিত অনুপ্রবেশ নিয়ে বিজেপির লাগাতার প্রচার এমন কী সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও তেমন আর সাড়া ফেলতে পারছে না।
ওই নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ একাধিকবার বলেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে কোনও বাংলাদেশি দূরে থাক, একটা পাখিও সীমান্ত টপকাতে পারবে না। বাংলাদেশের প্রান্তিক জেলাগুলোর মানুষ এখনও রুটি-রুজির সন্ধানে ভারতে এসেই চলেছেন এবং তাতে ভারতের সম্পদের ওপর চাপ পড়ছে, সাক্ষাৎকারে এমনও দাবি করেছিলেন তিনি।
দিল্লিতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক কল্যাণ গোস্বামীর কথায়, “এদেশে (ভারতে) বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ন্যারেটিভটা এতদিন চলে এসেছে, তাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আজকের বাংলাদেশ যে একটা অর্থনীতির ‘সাকসেস স্টোরি’, ভারতীয়রা ক্রমেই সেটা আরও বেশি করে অনুধাবন করছেন।”
বাংলাদেশে উপার্জন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ এখন অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশিদের অযথা ভারতে আসার কোনও কারণ নেই এটা ভারতীয়রা বুঝতে পারছেন বলেই বিজেপির অবৈধ অনুপ্রবেশের ত্ত্ত্ব সেভাবে আর সাড়া ফেলতে পারছে না বলেও ড. গোস্বামীর অভিমত।
আরএসএসের ঘনিষ্ট গবেষক রাভি পোখার্না আবার কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। মুম্বাইতে আরএসএস প্রভাবিত এনজিও ‘রামভাউ মহালগি প্রবোধিনী’র সিইও তিনি। মুম্বাইতে কথিত ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশে’র প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে বছর দুয়েক আগে তাদের প্রতিষ্ঠান একটি ফেলোশিপও চালু করেছিল।
রাভি পোখার্না বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে কিন্তু অর্থনীতির বিকাশ মোটেই সুষমভাবে হয়নি। একটা শ্রেণি ধনী থেকে আরও ধনী হচ্ছেন। জিডিপিতে তার ছাপ পড়ছে। কিন্তু আর একটা শ্রেণির কাছে সেই উন্নয়নের হাত পৌঁছায়নি। সেই গরিব মানুষগুলোর কাছে কিন্তু ভারতে আসার আকর্ষণ রয়েই গেছে বলে মনে করি।’
কলকাতার নামী অর্থনীতিবিদ সৈকত সিংহরায় পরিষ্কার বলছেন, ‘যাকে যার কৃতিত্ব দিতেই হবে– অ্যান্ড দিজ ইজ দ্য মোমেন্ট ফর বাংলাদেশ!’
তাঁর পরিষ্কার কথা, অর্থনীতি আর প্রবৃদ্ধিতে তুঙ্গস্পর্শী সাফল্যই বাংলাদেশকে ইদানীং অন্য নজরে দেখতে ভারতীয়দের বাধ্য করেছে এবং এই প্রবণতা এখন বেশ কিছুকাল অব্যাহত থাকবে বলেই অর্থনীতির সব সূচক ইঙ্গিত দিচ্ছে।